২৪ এপ্রিল সংগ্রামী দৃঢ়তা ও আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী চির অম্লান খাপড়া ওয়ার্ড দিবস
১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য একটি স্মরণীয় দিন। এ দিনটি হলো প্রকৃত স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তির জন্য শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে মুক্তি অর্জনের জন্য আত্মত্যাগের এক মহাকাব্য রচনার দিন, আত্মউৎসর্গ করার এক সুমহান গৌরবোজ্জল ইতিহাস সৃষ্টির দিন। আর তথাকথিত স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের নামে প্রতারকদের অমানবিক, স্বৈরাচারী বর্বরতার চরিত্রকে উন্মোচন করে, সকল অত্যাচার-নিপীড়ন ও দাসত্বের ভ্রুকুটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সমগ্র শোষিত নিপীড়িত জনগণকে সংগ্রামে উদ্বেলিত করার দিন এবং প্রতিবাদের পথে অগ্রসর করার এক সুমহান দৃষ্টান্ত।
১৯৫০ সালের এই দিনে স্বাধীনতার নামে নব্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকার রাজশাহীর কেন্দ্রীয় কারাগারে খাপড়া ওয়ার্ডে নিরস্ত্র কারাবন্দীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ৭ জন কমিউনিস্ট বিপ্লবীকে হত্যা ও অসংখ্য বিপ্লবীদের আহত করে এক নারকীয় তা-ব পরিচালনা করে। এই দিনে শহীদ হন কমরেড হানিফ শেখ, কমরেড বিজন সেন, কমরেড সুধীন ধর, কমরেড কম্পরাম সিং, কমরেড আনোয়ার হোসেন, কমরেড দেলোয়ার ও কমরেড সুখেন ভট্টাচার্য।
১৯৪৭ সালের ১৪আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত নামে দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিক ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ভারতকে বিভক্ত করে এই রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। অনেক ঢাকঢোল বাজিয়ে এই দুটো রাষ্ট্রীয় চরিত্রকে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে প্রচারণা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা ছিলো সাম্রাজ্যবাদীদের এক ঘৃণ্য চক্রান্ত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার কৌশল পাল্টিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বোযুদ্ধত্তোর কালে নয়া ঔপনিবেশিক কৌশল গ্রহণ করে। এদেশে তার শিক্ষা দেয়া দুই এজেন্ট সামন্তবাদ ও আমলা দালাল পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারীদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে নিজেকে আড়ালে নিয়ে যায়। সাম্রাজ্যবাদের ভাগ কর শাসন কর (Divide and rule) নীতির প্রেক্ষিতে প্রতিক্রিয়াশীল দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপনিবেশিক ভারতের হিন্দু সামন্ত-মুৎসুদ্দি পুঁজি ও মুসলিম সামন্ত-মুৎসুদ্দি পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী দালাল সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব তীব্র করাসহ সমগ্র জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে দ্বিধা বিভক্ত করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সেদিন এই দুই দালালদের দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে বিভক্ত করে দুটি নয়া ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। ফলে ভারত ও পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্র দুটির জন্ম নেয় তা সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলনের পরিণতিতে গড়ে ওঠে না বিধায় জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হয় না। আরও ধূর্ত কৌশলে নয়া ঔপনিবেশিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়। সাম্রাজ্যবাদীরা এই প্রতারণাপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করে সেদিনকার বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে। ১৯১৭ সালে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে গেলে বিশ্ব শ্রমিক আন্দোলনে এক মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায়। বিশ্বব্যাপী উপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্ব বিপ্লবের অংশে পরিণত হয়। সবচেয়ে অগ্রসর শ্রেনী শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার শর্ত তৈরি হয়। তাই রাশিয়ার বিপ্লবের পর বিশ্বব্যাপী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব নতুন গতিবেগ পেয়ে এক মহাতরঙ্গ সৃষ্টির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৩৯-৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন ঔপনিবেশিক দেশে জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন সশস্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে মহাতরঙ্গে রূপ নিতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমিক শ্রেণীর হাতে হিটলারের পতনের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করে। ফলে সকল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর নিপীড়িত জাতিগুলি নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সুসম্পন্ন করার পথে অগ্রসর হতে থাকে। পূর্ব ইউরোপের ৭টি দেশে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে। ভারতবর্ষের শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ সেদিন পিছিয়ে থাকেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষকদের তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ, তেভাগা, টঙ্ক, নানকার আন্দোলনসহ অসংখ্য বিদ্রোহ দানাবেঁধে ওঠে, যা সশস্ত্র রূপে জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরকম একটা প্রেক্ষাপটে সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজবাদ ভারতের সামন্ত-মুৎসুদ্দি শোষক গোষ্ঠীর রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ এই দুই সামন্ত-মুৎসুদ্দিদের হাতে দুটো নয়া ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের শাসনভার অর্পণ করে। যাদের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র হলো সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও দালাল পুঁজির স্বার্থ সংরক্ষিত ও অগ্রসর করা।
আমেরিকার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেস তার যুদ্ধ ও শান্তি নামক পুস্তকে এই কৌশল গ্রহণের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হইবার সাথে সাথেই সবচাইতে বড় এক রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিল- ঔপনিবেশিক সমস্যা। পশ্চিম যদি ঔপনিবেশিক পূর্বাবস্থা বজায় রাখিবার জন্য প্রচেষ্টা চালাইত তাহা হইলে সশস্ত্র বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং এই সশস্ত্র বিপ্লবে (পশ্চিমের) পরাজয়ও ছিল অবশ্যম্ভাবী।’
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান যেহেতু জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবরে পরিণতিতে হয়নি, ফলে পাকিস্তানের জনগণের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় না। সমাধান হয় না জাতিগত নিপীড়নের। নয়া কৌশলে ঔপনিবেশিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থা থেকে যায় অক্ষত। সেদিন সামন্ত-মুৎসুদ্দি ও অন্যান্য পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক দলসমূহ একে স্বাধীনতা বলে মেনে নিলেও শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি এই বিভ্রান্তিকে মেনে নেয়নি। তাই ১৯৪৮ সালে ঘোষণা করা হয়েছিল “ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।” কমিউনিস্ট পার্টি সেদিন জাতীয় গণতাান্ত্রিক বিপ্লবের অসম্পূর্ণ কাজকে অগ্রসর করার আহ্বান জানায়। আর এ কারণে সরকারের তরফ থেকে কমিউনিস্টদের ওপর নেমে আসে চরম আক্রমণ ও নির্যাতন। ঔপনিবেশিক কায়দায় পাকিস্তান সরকার জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ওপর স্বৈরাচারী পন্থায় দমন পীড়ন শুরু করে। হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, গ্রেফতারের বিভীষিকা ছড়িয়ে দেয়। অসংখ্য কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক কর্র্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। আর কারাগারগুলো নিরীহ ও নিরস্ত্র বন্দীদের বিভৎস নির্যাতনের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের উত্তরাধিকার হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। সেদিন জেলখানার ভেতর সকল গণতান্ত্রিক কর্মীরা আধুনিক যুগে কারাবন্দীদের ন্যায্য মানবিক অধিকারের দাবিকে সোচ্চারভাবে তুলে ধরেন। এই দাবির পক্ষে জেলখানায় অনশন আন্দোলন শুর হয়। ৩১, ৪২, ৪৯ এবং ৬২ দিনের অনশন ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। ৬২ দিনের অনশন ধর্মঘটের ফলে ১৯৫০ সালের এপ্রিলে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কুষ্টিয়ার কমিউনিস্ট নেতা কমরেড শিবেন রায়ের মৃত্যু ঘটে। আন্দোলনের চাপে জেল কর্তৃপক্ষ বিনাবিচারে আটক রাজবন্দীদের রাজনৈতিক মর্যাদার দাবি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। রাজশাহীর জেলবন্দীরাও এই আন্দোলনে সোচ্চার ও গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারাগারে এই আন্দোলনকারী কারাবন্দীদের শায়েস্তা করার জন্য সরকার নতুন ষড়যন্ত্র আটতে থাকে। রাজশাহী জেলেও নতুন নতুন ষড়যন্ত্র কারাবন্দীদের ওপর চাপানো হতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে রাজশাহী জেলের রাজবন্দীদের পক্ষ থেকে জেলখানায় বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার প্রস্তাব রাখা হয়। এ প্রেক্ষিতে ইনস্পেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্স রাজশাহীতে ভিজিটে আসলে জেলবন্দীদের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব রাখা হয়। কিন্তু আই জি প্রিজন্স আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে শর্ত দেয় যে, রাজবন্দীদের ‘ফাইলে’ বসে তাকে ‘সরকারি সালাম’ দিয়ে সম্মান করতে হবে। যার অর্থ হলো বন্দীদের দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসতে হবে একজন জেল সেপাই ‘সরকার সালাম’ বলে ঘোষণা করলে বন্দীরা দাঁড়িয়ে করজোরে হাত তুলে তাকে সালাম দেবে। আইজ প্রিজন্সের এই অমর্যাদাকর প্রস্তাব রাজবন্দীরা প্রত্যাখ্যান করেন।
আইজি পিজন্স পরে বন্দীদের সাথে দেখা করার ও আলোচনার প্রস্তাব গ্রহণ করে। রাজবন্দীদের পক্ষ থেকে আলোচনায় প্রতিনিধি থাকেন কমরেড আবদুল হকসহ ১২ জন প্রতিনিধি। তাদেরকে জেলগেটে দাঁড় করিয়েই আলোচনা শুরু করার চেষ্টা চালায় আইজি প্রিজন্স। কিন্তু জেলবন্দী প্রতিনিধিগণ বসার ব্যবস্থা না হলে আলোচনা করবেন না বলে জানান। ফলে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের বসার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়। প্রতিনিধিগণ জেলখানার ভিতর কারাবন্দীদের ওপর চেপে বসা বিভিন্ন মানবিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এতে কারা কর্তৃপক্ষ চটে যান। আইজিপি ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিনিধিদের বলে যে, তারা কয়েদির সমস্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে কেন ? কিন্তু প্রতিনিধিরা বলেন, গণতান্ত্রিক কর্মী হিসাবে এটা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। এই কথায় আইজি প্রিজন আরও চটে যায়। তিনি জেলখানা ত্যাগ করার সময় অর্ডার করে যান এই প্রতিনিধিসহ ১৪ জনকে কনডেম সেলে স্থানান্তরিত করার।
কারা কর্তৃপক্ষের এই অন্যায় হুকুম কারাবন্দীরা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল কারাবন্দীরা এই সমস্যা নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন ছিলেন। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেছিলেন কমরেড হানিফ শেখ। এই আলোচনারত অবস্থায় জেল সুপার মিঃ বিলের নেতৃত্বে ২ জন ডেপুটি জেলারসহ পঁচিশ/ত্রিশ জনের এক বহর খাপড়া ওয়ার্ডে ঢুকে পড়ে। সুপার সরাসরি কমরেড আবদুল হক’র সামনে যেয়ে বলে, “হক, প্রস্তুত হন। আপনাদের কাউকে কাউকে পৃথক করা হবে (Be ready Haque, some of you are to be segregated now.)। কমরেড আবদুল হক সঙ্গে সঙ্গে বলেন, বসুন, এ ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে হবে (Just sit down please, we have talk with you about this matter.)। সঙ্গে সঙ্গে মিঃ বিল চিৎকার করে ওঠেন, চুপ কর (Shut-up) এই বলে ছুটে তিনি ওয়ার্ডের বাইরে বের হয়ে বাঁশিতে হুইসেল দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৪০ জন সেপাই বাঁশের লাঠি নিয়ে কারাবন্দীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারাবন্দীরা চেষ্টা করতে থাকে আত্মরক্ষার। নিরস্ত্র বন্দীদের ওপর চলতে থাকে এক বিভৎস তান্ডব। কিছুক্ষণ পরেই সেপাইরা খাপড়া ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় এবং জানালা দিয়ে সশস্ত্র সেপাইরা রাইফেল তাক করে শুরু করে নির্মম গুলিবর্ষণ।
নিরস্ত্র কারাবন্দীদের ওপর এভাবে গুলিবর্ষণ সকল পৈশাচিক বর্বরতাকেও হার মানিয়ে দেয়। গুলিতে নিহত হন ৭ জন ও আহত হন কমরেড আবদুল হক সহ অসংখ্য কারাবন্দী। কমরেড আবদুল হককে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাকে বাঁচানোর জন্য কমরেড আনোয়ার আবদুল হককে ঠেলে সরিয়ে দিলে সেই গুলিতেই কমরেড আনোয়ার শহীদ হন। খাপড়া ওয়ার্ডটি রক্তের স্রোতে ভেসে যায়। এখানেই কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিশোধের স্পৃহা মেটে নাই। বিলের নেতৃত্বে আহত বন্দীদের ওপর চালানো হয় আর এক দফা হামলা। বিল হান্টার নিয়ে আহতদের মধ্যে কমরেড আবদুল হককে খুঁজে বের করে সরাসরি তার মাথা লক্ষ্য করে আঘাত করে। কমরেড আবদুল হক তখন হাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ছটফট করছিলেন। এই আঘাত খাওয়ার পর তার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ওঠে এবং তিনি অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েন। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডটিতে ছিলো সেদিন নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার এক জঘণ্য প্রকাশ। এই বর্বর আক্রমণ ও নৃশংসতা আসলে বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা ছিল না। তাই এ ঘটনার মধ্যে দিয়ে ১৯৪৭ সালের তথাকথিত স্বাধীনতা অর্জনের নামে প্রতারণাপূর্ণ নয়া ঔপনিবেশিক চরিত্রটার মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়।
২৪ এপ্রিল নিহত ও আহত কমরেডরা তাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে নয়া ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকাকে শুধু সমুন্নতই করলেন না বরং তাকে আত্মত্যাগ, সাহস ও বীরত্বের মহিমা দিয়ে নতুন শক্তিতে গতিবেগ তৈরি করলেন। যার প্রভাবে পরবর্তীকালে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একের পর এক সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৭১ সালে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় রুশ ভারতের আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা দালাল পুঁজি বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিণতিতে গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিপ্লব ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ধ্বংস ও সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যজ্যবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর অবাঙ্গালী সামন্ত মুৎসুদ্দিদের সাথে বাঙালী সামন্ত মুৎসুদ্দিদের ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। তাই নব্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ অবাঙালি সামন্ত মুৎসুদ্দিদের স্থানে বাঙালি সামন্ত মুৎসুদ্দিদের ক্ষমতায় আনা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি জাতির মুক্তি আসেনি। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোন প্রশ্ন ওঠে না।
প্রতিদিনের বাস্তবতায় আজ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের শোষণ-লুণ্ঠন তীব্র থেকে তীব্রতার হয়ে চলেছে। একের পর এক গণতান্ত্রিক অধিকার পদদলিত করে স্বৈরাচারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। শোষণ ও হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, নির্যাতন, বেকারত্ব, চাকুরিচ্যুতিসহ সকল মৌলিক অধিকার হারিয়ে জনগণ আজ দিশেহারা । জেলগুলোতে এখনও চালানো হচ্ছে বর্বর নির্যাতন এবং নিরস্ত্র বন্দীদের ওপর গুলিবর্ষণের বিভিন্ন ঘটনা অর্থাৎ ঔপনিবেশিক কায়দায় শোষণ নির্যাতন প্রতিদিন আরও পরিস্ফুটিত হয়ে উঠছে। তাই ২৪ এপ্রিল খাপড়া ওয়ার্ড দিবস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতা, আত্মমর্যাদার জন্য নয়া ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে আত্মত্যাগ, সহস ও দৃঢ়তা দিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পতাকাকে এগিয়ে নেয়ার। তাই, এই দিনে মহান শহীদ কমরেডগণ তাদের রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আমাদের দেশের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে লাল পতাকা আরও সমুন্নত করে গেছেন, তাকে আমাদের আজ অগ্রসর করে নিয়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমাপ্ত করার জন্য দৃঢ় শপথ গ্রহণ করতে হবে।