তারিখ ঃ ১৮/১১/১৭ প্রেসবিজ্ঞপ্তি
‘পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার গভীর সংকট এবং রুশ বিপ্লবের মহান শিক্ষা ও বৈপ্লবিক দিকনির্দেশনা’ শীর্ষক সেমিনার
আজ ১৮ নভেম্বর ২০১৭ শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় যশোর প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। মহান রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকী উদযাপন কমিটির উদ্যোগে জনাব তোজাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করে উদযাপন কমিটির অন্যতম সদস্য ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান কবির। অতিথি হিসেবে আলোচনা করেন ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) এর সাবেক সভাপতি জনাব এম.আর. খায়রুল উমাম ও শহীদ মসিউর রহমান ডিগ্রিী কলেজ, ঝিকরগাছা, যশোর এর অধ্যক্ষ জনাব পাভেল চৌধুরী। আরো আলোচনা করেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ দত্ত, সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম শামীমুল হক, কৃষক সংগ্রাম সমিতির কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যাপক তাপস বিশ্বাস, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের যশোর জেলা সভাপতি আব্দুল হক ও জাতীয় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কামরুল হক লিকু প্রমুখ। সঞ্চালন করেন হাফিজুর রহমান।
আলোচকবৃন্দ বলেন, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থায় চলমান মন্দা-মহা মন্দার দিকে ধাবিত হওয়ায় মন্দা থেকে উদ্ধার পেতে বাজার প্রভাব বলয়, পুনর্বণ্টন নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে যে যুদ্ধ প্রস্তুতি অগ্রসর হচ্ছে তা মোকাবেলা করতে গেলে মহান রুশ বিপ্লবের অজেয়-অমর শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা সামনে রেখে অগ্রসর হতে হবে। বিপ্লব তথা শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণের বিরুদ্ধে সংশোধনবাদী-সুবিদাবাদীরা আজ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে যে ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে তারও প্রকৃত স্বরূপ উম্মোচন করে বিপ্লবী বিকল্প ধারা অগ্রসর করতে হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক পার্টির গঠন প্রক্রিয়া থেকে সকল রূপের সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে পার্টি গড়ে উঠেছিল। আমাদের দেশের সংশোধনবাদীরা আজ একত্রিত হয়ে মাসব্যাপী যে কর্মসূচী পালন করছে তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর নের্তৃত্বে, শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব ও মহান কমরেড স্টালিনের অবদানকে অস্বীকার করে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় শান্তিপূর্ণ পথে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের হালুয়া রুটির অংশীদার হওয়া।
মহান রুশ বিপ্লবের এই প্রেক্ষাপটে সমকালীন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতিতে একদিকে বিশ্বের দেশে দেশে বিশেষ করে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে অর্জিত অধিকার কর্তন ও সংকটের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া এবং সংকট মোকাবেলায় ফ্যাসিবাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার দিকটি সামনে আসছে। আর আমাদের মত নয়াউপনিবেশিক দেশগুলোতে শোষণ-লুন্ঠনের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করতে গিয়ে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের ওপর নির্মম শোষণ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদী পথ ধরে সকল ধরনের প্রতিবাদ ও তাদের স্বার্থে যতটুকু অধিকার ছিলো তাও আজ হরন করে চলেছে। অন্য দিকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থল সংযোগ সেতু বঙ্গোপসাগরীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতি ও রণনীতিগত গুরুত্বের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসীযুদ্ধের বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের দালাল ক্ষমতাসীন মহাজোট ও বিএনপি’র নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোট। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে রুশ বিপ্লবের শিক্ষাকে সামনে রেখে বিশ্ব সর্বহারা শ্রেণী, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের বৈপ্লবিক সংগ্রাম অগ্রসর করা এবং পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ও নয়াউপনিবেশিক ব্যবস্থা উচ্ছেদ সাধন করার প্রয়োজনীয় সামনে রয়েছে। রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকীতে এই শিক্ষাকে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণকে সামনে রেখে অগ্রসর হতে হবে। সেমিনারের পূর্বে বেলা আড়াই টা থেকে ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদের সহযোগিতায় অক্টোবর বিপ্লবের ওপর কিছু প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়।
বার্তাপ্রেরক
প্রকাশ দত্ত
সহ-সাধারণ সম্পাদক
এনডিএফ কেন্দ্রীয় কমিটি
০১৯২৪০৪৮১৩৯
‘পুঁজিবাদী–সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার গভীর সংকট এবং রুশ বিপ্লবের মহান শিক্ষা ও বৈপ্লবিক দিকনির্দেশনা’ শীর্ষক সেমিনার
সংগ্রামী সভাপতি,
বিপ্লবী অভিনন্দন গ্রহণ করুন। এবারে আমরা পালন করছি মহান অক্টোবর বিপ্লব তথা সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকী। রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকী পালন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলছে ব্যাপক তৎপরতা। কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তি দিবসটি পালন করছে মহান অক্টোবর বিপ্লবের অজেয় ও অমর শিক্ষাকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ তথা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বিশ্বব্যপী বিকাশমান চমৎকার বস্তুগত বিপ্লবী পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং নয়াউপনিবেশিক-আধাসামন্তবাদী দেশগুলোতে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত করে অগ্রসর হবে বিশ্ব বিপ্লব তথা সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার সুমহান লক্ষ্যে। এর বিপরীতে সকল রূপের সুবিধাবাদী-সংশোধনবাদীরা রুশ বিপ্লবের মূল শিক্ষাকে আড়াল ও অস্বীকার করে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণকে বিভ্রান্ত, বিভক্ত ও বিপথগামী করার লক্ষ্যে দিবসটি পালন করছে। আমাদের দেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। মার্কিন নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদসহ সকল সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলরা ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ব্যর্থ, সমাজতন্ত্র ব্যর্থ এবং পুঁজিবাদ শ্বাশ্বত ও সংকটমুক্ত’ বলে যে প্রতিবিপ্লবী প্রচারাভিযান চালায়, তার বেঠিকতা প্রমাণিত হচ্ছে সমগ্র পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় চলমান দীর্ঘস্থায়ী বৈশ্বিক মন্দা ও সংকটের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম এবং বর্তমানের কঠোর বাস্তবতায় অক্টোবর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা আরো সামনে আসছে, সামনে আনছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী বিকল্পকে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার বলশেভিক পার্টি তথা শ্রমিকশ্রেণী বলপ্রয়োগে বুর্জোয়া শ্রেণীকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত করলে পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা ঘটে। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বিপরীতে জন্ম নেয় সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা। সূচিত হয় সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগ। পুঁজিবাদের পর্যাক্রমিক সংকটের ধারাবাহিকতায় রুশ বিপ্লবের পর সূচিত হলো পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের প্রথম পর্যায় (1st phase of general crisis of capitalism)। শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতা দখলের প্রথম প্রচেষ্টা ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের ধারাবাহিকতায় রাশিয়ায় ১৯০৫ সালে ‘বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সেল’ এবং ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় অক্টোবর বিপ্লব সর্বহারা একনায়কত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা সোভিয়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। বিশ্বব্যাপী কার্যকর তিন মৌলিক দ্বন্দ্বের সাথে আরেকটি মৌলিক দ্বন্দ্ব পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব যুক্ত হয়ে সামনে আসে চার মৌলিক দ্বন্দ্ব। ‘দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী এক হও’-এই মৌলিক শ্লোগানের সাথে বর্তমান যুগের বাস্তবতায় সামনে এলো ‘দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী, নিপীড়িত জাতি ও জনগণ এক হও’ শ্লোগান। অতীতের সামাজিক বিপ্লবের মতো এক শ্রেণীর শোষণের পরিবর্তে আরেক শ্রেণীর শোষণ নয় বরং রুশ বিপ্লব অবসান ঘটালো মানুষ কর্তৃক মানুষকে শোষণ করার সমাজব্যবস্থা। সর্বহারা একনায়কত্বাধীনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক বিনির্মাণের যাত্রাবিন্দু। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও বিনির্মাণ প্রক্রিয়া অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় শ্রেণী শোষণ-লুণ্ঠন, দারিদ্র-বেকারত্ব দূর হওয়াসহ শ্রমিক-কৃষক-জনগণের ৫টি মৌলিক চাহিদা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা পূরণ হয়। শ্রেণী শোষণের অবসানের মধ্য দিয়ে নিপীড়িত জাতিসত্তাসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার, নারী মুক্তি, শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতিসহ সাংস্কৃতিক বিপ্লব, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনসহ চিন্তা-চেতনার বৈপ্লবিক রূপান্তরের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। রুশ বিপ্লব দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী, নিপীড়িত জাতি ও জনগণের সামনে মুক্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে পথ প্রদর্শন করে।
কমরেড লেনিন মার্কসবাদের আলোকে রুশ বিপ্লব সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদকে আরো বিকশিত পর্যায়ে উন্নীত করেন। ফলে শ্রমিকশ্রেণী এবং তার পার্টির পথপ্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে সামনে আসে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। কমরেড স্টালিন তার লিখিত বিখ্যাত পুস্তক ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’তে লেনিনবাদের সংজ্ঞা প্রদান করে বলেন, “লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ”। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, “লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে সর্বহারা বিপ্লবের তত্ত্ব ও কৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো সর্বহারা একনায়কত্বের তত্ত্ব ও কৌশল।” পুঁজিবাদের অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ তথা প্রাক একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে মার্কস-এঙ্গেলস তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। লেনিন তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় সাম্রাজ্যবাদের যুগে। সাম্রাজ্যবাদের এই যুগ শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যে তিনটি চরিত্র ও ৫টি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন তার কার্যকারিতা, তাৎপর্য, গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা আজো অম্লান। সাম্রাজ্যবাদের ৩টি চরিত্র হচ্ছে-১) একচেটিয়া পুঁজিবাদ (Monopoly Capitalism) ২) ক্ষয়িষ্ণু বা পরজীবী পুঁজিবাদ (Decaying or Parasitic Capitalism) এবং ৩) মুমূর্ষ পুঁজিবাদ (Moribund Capitalism) [সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতন্ত্রে বিভক্তি, লেনিন খণ্ড-৩১] এবং সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর পুস্তকে পাঁচটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন তা হচ্ছে –
১. উৎপাদন ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন এমন একটা পর্যায়ে বিকাশ লাভ করেছে যে, তা সৃষ্টি করেছে একচেটিয়াবাদের যা অর্থনৈতিক জীবনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে।
২. শিল্পপুঁজির সাথে ব্যাংকপুঁজির সম্মিলন, লগ্নিপুঁজির (Finance Capital) ভিত্তিতে এক লগ্নিকারী ক্ষুদে গোষ্ঠীর (Finance oligarchy) সৃষ্টি।
৩. পুঁজি রপ্তানী যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পণ্য রপ্তানী থেকে যা আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
৪. আর্ন্তজাতিক পুঁজিবাদী একচেটিয়াবাদের উৎপত্তি, যারা দুনিয়াটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে।
৫. সবচেয়ে বৃহৎ পুঁজিবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে সমগ্র বিশ্বের আঞ্চলিক ভাগ-বণ্টন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে।
কমরেড লেনিন পুঁজিবাদের অসম বিকাশের নিয়ম সাম্রাজ্যবাদের যুগে সবিশেষ তীব্রতা লাভ করে এবং বাজার-পুনর্বণ্টনের জন্য সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জন্ম দেওয়ার বিষয় তুলে ধরে এক বা একাধিক দেশে বিপ্লবের বিজয়ের সম্ভাবনা ও অপরিহার্যতাকে সামনে আনেন। লেনিন বলেন, “অর্থনৈতিক রাজনৈতিক বিকাশে অসমতা পুঁজিতন্ত্রের একটি অমোঘ নিয়ম। সুতরাং প্রথমে কয়েকটি দেশ, এমনকি একটি মাত্র দেশেও সমাজতন্ত্রের বিজয় সম্ভব। সেই দেশে বিজয়ী সর্বহারা শ্রেণী পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ঘটিয়ে এবং নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা সংগঠিত করে সমস্ত পৃথিবীর বাকি দেশগুলির বিরুদ্ধে, পুঁজিতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এবং অন্যান্য দেশের অত্যাচারিত শ্রেণীগুলিকে স্বপক্ষে আকৃষ্ট করবে।” (ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্রের আওয়াজ, লেনিন, আগস্ট-১৯১৫ )।
লেনিন সর্বহারা বিপ্লবের তত্ত্বের প্রেক্ষিতে তিনটি মৌলিক থিসিস উল্লেখ করে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ফ্রন্টের বিরুদ্ধে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলিতে সর্বহারা বিপ্লব এবং প্রাচ্যের ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিপ্লবের জোট গঠনে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এভাবে লেনিন এসব সিদ্ধান্তগুলো সমন্বিত করে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত টেনে বলেন, ‘সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাক্কাল’। লেনিন সাম্রাজ্যবাদী যুগে সর্বহারা বিপ্লবের পূর্ব শর্তসমূহের বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে পূর্বেকার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে অধিকাংশ দেশ তথা বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণের কথা বলেন; বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতির ব্যবস্থায় বিপ্লবের বস্তুগত শর্তের অস্তিত্ব থাকার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন; বিশ্ব সর্বহারা বিপ্লবের প্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব ফ্রন্টের একক শিকলের গ্রন্থি হিসেবে পুঁজির জাতীয় ফ্রন্টকে দেখা এবং সকল দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের সাধারণ ফ্রন্ট দ্বারা তার বিরোধিতা করার কথা বলেন; এখন সর্বহারা বিপ্লবকে প্রধানত সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার দ্বন্দ্বসমূহের বিকাশের ফলশ্রুতিতে, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল এক বা অন্য দেশে ভাঙ্গার ফল হিসেবে দেখার কথা বলেন। এভাবে কমরেড লেনিন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থি ছিন্ন করার ফল হিসেবে বিপ্লবকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। (সূত্র- লেনিনবাদের ভিত্তি)
বিপ্লবের বিজয় আপনা আপনি হয় না। সে জন্য সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থি ভাঙ্গার জন্য আত্মগত শক্তির (Subjective Factors) প্রয়োজন। কমরেড লেনিন তা গড়ে তুলতে এবং বস্তুগত বিপ্লবী পরিস্থিতির সাথে তাকে সমন্বিত করতে নেতৃত্ব প্রদান করেন। বিপ্লবের আত্মগত শক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর বলশেভিক ধরনের মনোলিথিক পার্টি- যে পার্টি সকল রূপের সংশোধনবাদ ও সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদী তত্ত্ব ও অনুশীলনে পারদর্শী; বিপ্লবের সঠিক কর্মসূচি, রণনীতি-রণকৌশল নির্ধারণে ও কার্যকরীকরণে দক্ষ; শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত; সাংগঠনিকভাবে সুশৃঙ্খল ও সুসংবদ্ধ। বিপ্লবকে জয়যুক্ত করতে সক্ষম এমন একটি শ্রমিকশ্রেণীর বলশেভিক পার্টি রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। এজন্য লেনিনকে পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে, আদর্শগত-রাজনীতিগত-তত্ত্বগত এবং সংগঠনগত প্রায়োগিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হয়। তাই লেনিনকে আপোষহীন নীতিনিষ্ঠ আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয় নারোদবাদী, অর্থনীতিবাদী, মেনশেভিক, বিলোপবাদী, অটজোভিস্ট, ট্রটস্কিবাদসহ নানা রূপের দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদ ও “বামপন্থি” হঠকারীদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ সকল রূপের সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে। ১৮৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গড়ে উঠলেও প্রয়োজনীয় আদর্শগত-রাজনীতিগত-সংগঠনগত তথা তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯১২ সালে ঐতিহাসিক প্রাগ সম্মেলনের মধ্যদিয়ে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বলশেভিক পার্টি। লেনিন বলশেভিক তথা লেনিনবাদী পার্টির ৬টি বৈশিষ্ট সূত্রবদ্ধ করেন – ১) পার্টি হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী ২) পার্টি হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর সংগঠিত বাহিনী, ৩) পার্টি হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রেণী সংগঠন, ৪) পার্টি হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব প্রয়োগের হাতিয়ার, ৫) পার্টি হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছাশক্তির প্রতীক, তার মধ্যে কোন উপদলীয় অস্তিত্ব থাকতে পারে না এবং ৬) সুবিধাবাদীদের বহিস্কার করে পার্টি শক্তিশালী হয়।
শ্রমিকশ্রেণীর বলশেভিক ধরনের পার্টি গঠনে পেশাদার বিপ্লবীদের গুরুত্ব তুলে ধরে বলশেভিক পার্টির ইতিহাসে বলা হয় যে, “পার্টির কাঠামো ও গঠন সম্বন্ধে লেনিনের মত ছিল এই যে, পার্টির দুইটি অংশ থাকিবেঃ (ক) পার্টির নেতৃস্থানীয় নিয়মিত কর্মীদের লইয়া একটি ঘনিষ্ঠ চক্র- এখানে প্রধানত সেই ধরনের কর্মীরা থাকিবেন যাঁহারা পেশাদার বিপ্লবী, অর্থাৎ এমন পার্টি কর্মী যাঁহারা পার্টির কাজ ছাড়া আর কিছু করেন না এবং যতটুকু থাকা দরকার অন্তত ততটুকু মার্কসবাদী জ্ঞান, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সংগঠনের অভ্যাস এবং জারের পুলিশের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ও এড়াইয়া যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন, (খ) স্থানীয় পার্টি সংগঠনগুলির সুবিস্তৃত জাল এবং বহু সংখ্যক এমন পার্টি সভ্য যাঁহারা লক্ষ লক্ষ মেহনতকারী জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন ভোগ করেন।” [সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির ইতিহাস, পৃ-৪০]
পার্টি কর্মসূচির ক্ষেত্রে কমরেড লেনিনকে সকল রূপের সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হয়। বিপ্লবের স্তর এবং রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ ও কার্যকরী করার জন্য লেনিনকে একদিকে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্ব ও আধিপত্য অস্বীকারকারী বুর্জোয়া লেজুড়বৃত্তিকারী মেনশেভিকদের দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদ, অন্যদিকে বিপ্লবের দুই স্তর গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে এবং বিপ্লবে কৃষকদের মিত্রের ভূমিকা অস্বীকারকারী ট্রটস্কির “বামপন্থি” হটকারিতার বিরুদ্ধে আপসহীন আদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়। গণতান্ত্রিক বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বের ভূমিকা তুলে ধরে কমরেড লেনিন বলেন, “বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারাশ্রেণী নেতা হতে পারে এবং নেতা তাকে হতেই হবে, রুশদেশে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীই হবে পরিচালিকা শক্তি”।
লেনিন রাশিয়ার বিপ্লবের স্তরের প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং এই দুই স্তরের আন্তঃসম্পর্ক ও নিরবচ্ছিন্নতার তত্ত্ব তুলে ধরেন। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরের রণনীতি হিসেবে কমরেড লেনিন বলেন, “বলপ্রয়োগে স্বৈরতন্ত্রের প্রতিরোধ উচ্ছেদ করার জন্য এবং বুর্জোয়াদের অস্থিরচিত্ততা অকেজো করার জন্য কৃষকদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লব করতে হবে।” (সোস্যাল ডেমোক্রেসির দুই রণকৌশল, লেনিন)। স্ট্যালিন লেনিনবাদের ভিত্তি পুস্তকে এই রণনীতি সারসংক্ষেপ করে বলেন যে, অন্য কথায়- “গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে, বুর্জোয়াদের অকার্যকর করে, সমগ্র কৃষক-শ্রেণীর সংগে, স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে”। শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে প্রতিষ্ঠা করতে হয় শ্রমিক-কৃষকের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি হিসেবে লেনিন বলেন, “বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিরোধ চূর্ণ করার জন্য এবং পেটি বুর্জোয়াদের আর কৃষকদের অস্থিরচিত্ততা অকেজো করার জন্য জনসাধারণের মধ্যকার আধাসর্বহারা অংশের সহযোগিতায় শ্রমিকশ্রেণীকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে।” স্ট্যালিন সারসংক্ষেপ করে বলেন, “অন্য কথায়- গরীব কৃষক ও জনসাধারণের আধাসর্বহারা অংশগুলোর সংগে একত্রে, শহর ও গ্রাম অঞ্চলের পেটি বুর্জোয়াকে নিরপেক্ষ করে তুলে, বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পক্ষে”। এ প্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে জয়যুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করতে হয় সর্বহারা একনায়কত্বাধীন রাষ্ট্র। কমরেড লেনিন গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পারস্পরিক সম্পর্ক ও রূপান্তরের প্রেক্ষিতে নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লবের (Un-interrupted Revolution) তত্ত্ব তুলে ধরে বলেন, “গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে আমরা অবিলম্বে এবং আমাদের শক্তির অর্থাৎ শ্রেণী সচেতনতা এবং সর্বহারা শ্রেণীর শক্তির অনুপাতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করবো। আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লবের পক্ষপাতী, আমরা মাঝপথে থেমে যাবো না” (কৃষক আন্দোলনের প্রতি সোস্যাল ডেমোক্রাটদের মনোভাব, লেনিন)।
মার্কসবাদের সবচেয়ে মৌলিক বিষয় হচ্ছে, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের মতবাদ। ১৮৫২ সালে কার্ল মার্কস বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব বা তাদের মধ্যকার সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব তার নয় বলে উল্লেখ করে তিনি তাঁর ৩টি অবদান তুলে ধরেন। তিনি প্রমাণ করেন- ১) উৎপাদনের বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরের সঙ্গেই শুধু শ্রেণীসমূহের অস্তিত্ব জড়িত ২) শ্রেণী সংগ্রাম অবশ্যম্ভাবী রূপে সর্বহারা একনায়কত্বে পৌঁছায়- ৩) এই একনায়কত্বটাই হলো সমস্ত শ্রেণীর বিলুপ্তির ও একটি শ্রেণীহীন সমাজে উত্তরণ মাত্র। কমরেড লেনিনের ‘মার্কসবাদের ৩টি উৎস ও অবিচ্ছেদ্য অংশ’ পর্যালোচনায় দেখা যায়, দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ, অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে সর্বহারা একনায়কত্বের মতবাদ মার্কসের আবিষ্কার ও অবদান। এ প্রসঙ্গে লেনিন বলেন, “যারা কেবল শ্রেণীসংগ্রামকে স্বীকার করে তারা তথাপি মার্কসবাদী নয়, একমাত্র সেই মার্কসবাদী যে শ্রেণীসংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা একনায়কত্বের স্বীকৃতি পর্যন্ত বিস্তৃত করে। মার্কসবাদী এবং সাধারণ পেটি (এবং বড়) বুর্জোয়াদের সাথে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গভীর পার্থক্য। এই কষ্টিপাথরই মার্কসবাদের সত্যিকার উপলব্ধি ও স্বীকৃতি যাচাই হওয়া উচিত”। (রাষ্ট্র ও বিপ্লব, লেনিন)। লেনিন আরো বলেন যে, পুরানো সমাজ ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কখনো রক্তপাতময় ও কখনো রক্তপাতহীন, কখনো হিংসাত্মক (Violent) ও কখনো শান্তিপূর্ণ, কখনো সামরিক ও কখনো অর্থনৈতিক, কখনো শিক্ষামূলক ও কখনো প্রশাসনিক নির্মম (Stubborn) সংগ্রাম হচ্ছে সর্বহারা একনায়কত্ব। (সংগৃহীত রচনাবলি, ১০ম খণ্ড)। লেনিন সর্বহারা একনায়কত্বের রূপ হিসেবে ঐতিহাসিক প্যারি কমিউনের শিক্ষাকে সামনে রেখে রাশিয়ার ক্ষেত্রে সোভিয়েত রাষ্ট্রকে কার্যকরী করেন। স্ট্যালিন বলেন, “সোভিয়েত শক্তি হচ্ছে সর্বহারা একনায়কত্বের রাষ্ট্রীয় রূপ।” তিনি আরো বলেন, “কমরেড লেনিন সোভিয়েত ব্যবস্থাকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের শ্রেষ্ঠ রূপ হিসেবে আবিষ্কার করেন।” সকল রূপের সংশোধনবাদীরা মার্কসবাদের মর্মবস্তু এই সর্বহারা একনায়কত্বকে অস্বীকার করে বুর্জোয়া একনায়কত্বের সাফাই গায়।
লেনিন বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্র চূর্ণবিচূর্ণ করে প্রতিষ্ঠা করেন সর্বহারার একনায়কত্ব। এ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট ইশতেহারে কার্ল মার্কস ও ফেডারিক এঙ্গেলস বলেন, কমিউনিস্টদের লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে বর্তমান সমাজব্যবস্থার বলপূর্বক উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে। কার্ল মার্কস বলেন, “সকল পুরাতন সমাজব্যবস্থার গর্ভে যখন নতুন সমাজ রূপ লাভ করে, তখন ধাত্রীর কাজ করে বলপ্রয়োগ।” লেনিন বলেন, মার্কস ও এঙ্গেলস-এর শিক্ষার মূলে রয়েছে বলপ্রয়োগে বিপ্লবের দৃষ্টিভঙ্গী। তাই রাজনৈতিক রণনীতি ও রণকৌশলের অধীন ও অংশ হিসেবে সামরিক রণনীতি ও রণকৌশলের গুরুত্ব সামনে আসে। “যুদ্ধ হচ্ছে অন্য উপায়ে (বলপ্রয়োগ) রাজনীতির ধারাবাহিকতা” এবং “সশস্ত্র অভ্যুত্থান হচ্ছে বিশেষ রূপের রাজনৈতিক সংগ্রাম, যা বিশেষ নিয়মের অধীন” সামরিক বিজ্ঞান সম্পর্কে মার্কস ও লেনিনের উল্লিখিত বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। সর্বহারা বিপ্লবের সামরিক কর্মসূচী প্রবন্ধে লেনিন যে দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেন, “তাত্ত্বিকভাবে এটা ভূলে যাওয়া বেঠিক হবে যে, প্রত্যেক যুদ্ধ হচ্ছে অন্য উপায়ে রাজনীতির ধারাবাহিকতা। বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হচ্ছে বৃহৎ শক্তির দুই গোষ্ঠির সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির ধারাবাহিকতা এবং এই রাজনীতি সাম্রাজ্যবাদী যুগের সম্পর্কগুলোর যোগফল থেকে বের হয়ে আসে এবং লালিত-পালিত হয়। এই বিশেষ যুগই অত্যাবশ্যকীয়ভাবে জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সর্বহারা সংগ্রামের রাজনীতির জন্ম দেয় এবং লালন-পালন করে। সুতরাং প্রথমত, জাতীয় বিপ্লবী বিদ্রোহ ও যুদ্ধ; দ্বিতীয়ত, বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীর যুদ্ধ ও বিদ্রোহ; এবং তৃতীয়ত, উভয় ধরনের বিপ্লবী যুদ্ধের সমন্বয় ইত্যাদির সম্ভাব্যতা ও অনিবার্যতা সৃষ্টি করে।” সংশোধনবাদীরা বলপ্রয়োগে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নিয়মকে অস্বীকার করে সামনে আনে শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারি পথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব। এই সংশোধনবাদী তত্ত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার সাথে সাথে মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা সংগ্রাম করে ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদের “বাম” হঠকারী মতবাদের বিরুদ্ধেও। লেনিন নারদনিকদের ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদের “বাম” হঠকারিতার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে সংগ্রাম চালান।
কমরেড স্ট্যালিন মার্কসবাদের ভাণ্ডারে কমরেড লেনিনের অবদানসমূহকে আলোকপাত করে ৬টি বিষয় তুলে ধরে বলেন,
প্রথমত: পুঁজিবাদের নতুন পর্যায় হিসেবে একচেটিয়া পুঁজিবাদের-সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্ন।
দ্বিতীয়ত: সর্বহারাশ্রেণীর একনায়কত্বের প্রশ্ন। এক্ষেত্রে লেনিনের নতুন অবদান ছিল এই যে, (ক) তিনি সোভিয়েত ব্যবস্থাকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় রূপ হিসেবে আবিষ্কার করেন, এর জন্য প্যারি কমিউন ও রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। (খ) তিনি সর্বহারা শ্রেণীর মিত্রের সমস্যার দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বহারা একনায়কত্বের সূত্রের ব্যাখ্যা দান করেন, সর্বহারা একনায়কত্বকে সংজ্ঞায়িত করেন পরিচালক হিসেবে সর্বহারা শ্রেণী এবং পরিচালিত হিসেবে অসর্বহারা শ্রেণীসমূহের (কৃষক ইত্যাদি) শোষিত জনগণের মধ্যকার শ্রেণী মৈত্রীর বিশেষ রূপ হিসেবে। (গ) তিনি এই বাস্তব ঘটনার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন যে, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব হলো শ্রেণী বিভক্ত সমাজে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ ধরন হচ্ছে সর্বহারা গণতন্ত্র। সংখ্যালঘিষ্ঠদের (শোষকদের) স্বার্থকে অভিব্যক্ত করে যে পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, তার সাথে তুলনায় সর্বহারা গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের (শোষিতদের) স্বার্থকেই অভিব্যক্ত করে।
তৃতীয়ত: সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের আমলে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহ দ্বারা পরিবেষ্টিত একটি দেশে সাফল্যের সাথে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার রূপ ও পদ্ধতির প্রশ্ন। এক্ষেত্রে লেনিনের নতুন অবদান ছিল এই যে, (ক) তিনি প্রমাণ করেন যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক পরিবেষ্টিত সর্বহারা একনায়কত্বাধীন একটি দেশে পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা যেতে পারে, আর তা এই শর্তে যে চারপাশের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর সামরিক হস্তক্ষেপ দ্বারা দেশটির টুঁটি চেপে ধরা হবে না। (খ) তিনি খুঁজে বের করেন অর্থনৈতিক কর্মনীতির সুনির্দিষ্ট লাইনগুলো (‘নয়া অর্থনৈতিক নীতি’) যার দ্বারা সর্বহারা শ্রেণীর অর্থনৈতিক মূল অবস্থানগুলোর (শিল্প, জমি, পরিবহন, ব্যাংক ইত্যাদি) অধিকারী হওয়ার সুবাদে সমাজতান্ত্রিক শিল্পকে কৃষির সাথে সংযুক্ত করে (শিল্প ও কৃষক অর্থনীতির মধ্যকার যোগসূত্র) এবং এভাবে সমগ্র জাতীয় অর্থনীতিকে সমাজতন্ত্রের দিকে পরিচালিত করে। (গ) তিনি খুঁজে বের করেন সমবায়ের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের গতিপথে কৃষক সমাজের মূল অংশকে পরিচালনা ও টেনে আনার সুনির্দিষ্ট পন্থা, যে সমবায় হলো সর্বহারা একনায়কত্বের হাতে ক্ষুদে কৃষক অর্থনীতির রূপান্তর সাধনের ও সমাজতন্ত্রের ভাবধারায় কৃষক সমাজের মূল অংশকে পূর্ণশিক্ষিত করে তোলার কাজে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
চতুর্থত: বিপ্লবে, প্রতিটি জনপ্রিয় বিপ্লবে, জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লব আর পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব- উভয় ক্ষেত্রেই সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব-আধিপত্যের প্রশ্ন। ….
পঞ্চমত: জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন। এক্ষেত্রে লেনিনের নতুন অবদান হলো, (ক) তিনি সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয় ও ঔপনিবেশিক বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে একটি একক সুসমন্বয়পূর্ণ পদ্ধতির মতামতে একীভূত করেন। (খ) তিনি জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নকে সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদের সাথে সংযুক্ত করেন। (গ) তিনি জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নকে আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবের সাধারণ প্রশ্নের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেন।
সর্বশেষ: সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি সম্পর্কিত প্রশ্ন। এক্ষেত্রে লেনিনের নতুন অবদান হলো সাম্রাজ্যবাদের আমলে সর্বহারা শ্রেণীর সংগ্রামের নতুন অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তিনি এসব রূপরেখা (মার্কস-এঙ্গেলস প্রদত্ত) আরো বিকশিত করেন এবং দেখিয়ে দেন যে, (ক) সর্বহারা সংগঠনসমূহের পূর্ণাঙ্গ রূপের (ট্রেড ইউনিয়ন, সমবয়, রাষ্ট্র সংগঠন) তুলনায় পার্টি হলো সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেণী সংগঠনের সর্বোচ্চ রূপ, পার্টির কাজ হলো সে সব সংগঠনের কাজের সাধারণীকরণ ও দিক-নির্দেশ প্রদান। (খ) সর্বহার শ্রেণীর একনায়কত্ব কেবলমাত্র পার্টির মাধ্যমে, একনায়কত্বের পরিচালক শক্তি হিসেবে পার্টির মাধ্যমেই কার্যকর হতে পারে। (গ) সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব পূর্ণাঙ্গ হতে পারে কেবল যদি তা একটি মাত্র পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত হয়, যে পার্টি অন্য পার্টির সাথে নেতৃত্ব ভাগাভাগি করে না এবং অবশ্যই তা করবে না। (ঘ) পার্টির মধ্যে যদি লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা না থাকে তা হলে শোষকদের দমন করা ও শ্রেণীবিভক্ত সমাজকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তর সাধনের ব্যপারে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের কর্তব্য সুসম্পন্ন হতে পারে না।
কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় মহান সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর ১৯১৯ সালে কমরেড লেনিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট (বলশেভিক) পার্টির নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠিত হয়। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের গঠিত তিনটি আন্তর্জাতিকের অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত সারসংকলন করে কমরেড লেনিন বলেন, “প্রথম আন্তর্জাতিকে (১৮৬৪-১৮৭২) স্থাপিত হয় পুঁজির উপর শ্রমিকদের বিপ্লবী আক্রমণের প্রস্তুতির জন্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের বুনিয়াদ। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (১৮৮৯-১৯১৪) হলো এমন আন্তর্জাতিক প্রলেতারীয় আন্দোলনের সংগঠন, যার প্রসার বাড়ছিল, ফলে বিপ্লবী মানের সাময়িক একটা হ্রাস, সুবিধাবাদের একটা সাময়িক প্রাবল্য না ঘটে যায়নি, শেষ পর্যন্ত যার পরিণতি হয় এ আন্তর্জাতিকের লজ্জাকর ভরাডুবিতে।
তৃতীয় আন্তর্জাতিক কার্যত গড়ে ওঠে ১৯১৮ সালে, যখন বিশেষ করে যুদ্ধের সময়ে সুবিধাবাদ ও সোস্যাল-শোভিনিজমের বিরুদ্ধে বহু বছরের সংগ্রাম প্রক্রিয়ায় একগুচ্ছ জাতির মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠিত হলো তার প্রথম কংগ্রেসে, মস্কোয় ১৯১৯ সালের মার্চে। এ আন্তর্জাতিকের বৈশিষ্ট্য, তার করণীয়- মার্কসবাদের অনুশাসন পূরণ ও সফল করা, সমাজতন্ত্র ও শ্রমিক আন্দোলনের যুগের আদর্শগুলিকে কার্যকর করা, তৃতীয় আন্তর্জাতিকের এই বৈশিষ্ট্যটি সঙ্গে সঙ্গেই আত্মপ্রকাশ করেছে এই দিক থেকে যে, এই নতুন, তৃতীয়, “আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতি” ইতিমধ্যেই কিছুটা পরিমাণে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রগুলির ইউনিয়নের সঙ্গে মিলে যেতে শুরু করেছে।
সমাজতন্ত্রের জন্য প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিক সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন হয় প্রথম আন্তর্জাতিকে।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক হলো অনেকগুলো দেশে আন্দোলনের ব্যাপক, গণপ্রসারের জমি প্রস্তুতির যুগ।
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের কাজের সুফলগুলি গ্রহণ করেছে তৃতীয় আন্তর্জাতিক, তার সুবিধাবাদী, সোস্যাল-শোভিনিস্ট, বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া গাদ ছেঁকে ফেলে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব কার্যকর করতে শুরু করেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বৈপ্লবিক আন্দোলন, পুঁজির জোয়াল উচ্ছেদের জন্য প্রলেতারিয়েতের আন্দোলন পরিচালনা করছে যে সব পার্টি, তাদের আন্তর্জাতিক সংঘের এমন একটা অভূতপূর্ব পাকা ঘাঁটি বর্তমান : একাধিক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, আন্তর্জাতিক আয়তনে তারা প্রলেতারীয় একনায়কত্ব, পুঁজিবাদের ওপর তাদের বিজয় রূপায়িত করছে।
তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের বিশ্ব ঐতিহাসিক তাৎপর্যটা এই যে, তা কার্যকর করতে শুরু করেছে মার্কসের মহত্তম ধ্বনি, সমাজতন্ত্র এবং শ্রমিক আন্দোলনের যুগ যুগব্যাপী বিকাশের সারার্থ নিহিত রয়েছে যে ধ্বনিতে, যে ধ্বনি অভিব্যক্ত হচ্ছে এই সংজ্ঞার্থেঃ প্রলেতারীয় একনায়কত্ব। (লেনিন, তৃতীয় আন্তর্জাতিক ও ইতিহাসে তার স্থান; খণ্ড-৩৮)
১৯১৯ সালের ২ থেকে ৬ মার্চ অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেসে কমরেড লেনিন উপস্থিত করেন বুর্জোয়া একনায়কত্ব ও সর্বহারা একনায়কত্বের উপর থিসিস। ১৯২০ সালে ২য় কংগ্রেসে গৃহীত হয় জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সম্পর্কিত থিসিস, কৃষি সংক্রান্ত প্রশ্ন, তৃতীয় আন্তর্জাতিকের গঠনতন্ত্র, ৩য় আন্তর্জাতিকের সভ্য হওয়ার ১৯-দফা শর্ত ইত্যাদি। জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন সম্পর্কিত থিসিস যা Colonial Theses নামে পরিচিত। এই থিসিসে পরাধীন, ঔপনিবেশিক, অনগ্রসর, নির্ভরশীল দেশগুলোর নিপীড়িত জাতি ও জনগণের মুক্তির পথনির্দেশনা প্রদান করা এবং এ সমস্ত দেশে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি তথা কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। লেনিন এই সব দেশগুলোতে কৃষকের সোভিয়েত (Peasant soviet), শ্রমজীবিদের সোভিয়েত (Toilers soviet) গড়ার দিকনির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, “এটাই প্রমানিত হয়েছে যে, কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের থিসিসে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কৃষকের সোভিয়েত, শোষিতের সোভিয়েত কেবল পুঁজিবাদী দেশে নয়, প্রাক-পুঁজিবাদী স্তরের দেশের জন্য একটি কার্যকরী অস্ত্র। আমাদের অবশ্যই বলতে হবে যে, কমিউনিস্ট পার্টি ও যারা কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন তাদের অবশ্য কর্তব্য হবে অনগ্রসর ও ঔপনিবেশিক দেশগুলোর কৃষকদের সোভিয়েত ও মেহনতি মানুষের সোভিয়েত গড়ার আদর্শ প্রচার করা; এ সব দেশে মেহনতি জনগণের সোভিয়েত গড়ে তোলার জন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাওয়াও তাদের কর্তব্য।” তাছাড়া এ সময়ে সম্পূরক থিসিসে চীন-ভারতের মতো আধাঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক দেশে যেখানে কিছু পরিমাণে শ্রমিকশ্রেণী আছে, সেখানে শ্রমিক-কৃষকের সোভিয়েত (Worker-peasant soviet)-এর কথা বলা হয়। এই থিসিসে ঔপনিবেশিক পশ্চাৎপদ দেশগুলো বিজয়ী শ্রমিকশ্রেণীর তথা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত সরকারের সহায়তা পেলে পুঁজিবাদী স্তর পরিহার করে অগ্রসর হতে পারে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী স্তর অনিবার্য নয়। এ প্রেক্ষিতে থিসিসে বলা হয় যে “…. কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিককে এই প্রতিপাদ্য উপস্থিত ও তাত্ত্বিকভাবে নিষ্পন্ন করতে হবে যে, অগ্রসর দেশের সর্বহারা শ্রেণীর সাহায্য নিয়ে পশ্চাৎপদ দেশ সোভিয়েত ব্যবস্থায় হাজির হতে পারে এবং বিকাশের নির্দিষ্ট স্তরগুলো পার হয়ে কমিউনিজমে পৌঁছাতে পারে পুঁজিবাদী স্তরের মধ্য দিয়ে না যেয়ে (Without having to pass through the capitalist stage)।” ১৯২১ সালে তৃতীয় কংগ্রেসে শ্রমিকশ্রেণীর যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার প্রশ্ন। ১৯২২ সালে ৪র্থ কংগ্রেসে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুক্তফ্রন্ট এবং ট্রেড ইউনিয়নে ঐক্যের জন্য কাজের প্রশ্ন। ১৯২৪ সালে ৫ম কংগ্রেসে বলশেভিক ধরনের পার্টি গড়ে তোলার, শ্রমিক যুক্তফ্রন্টের কৌশল ইত্যাদি সামনে আসে। ১৯২৮ সালে ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কর্মসূচী (Program of communist international), তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে অগ্রসর করা হয়। ১৯৩৫ সালে ৭ম কংগ্রেসে ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যের থিসিস যা ডিমিত্রভ থিসিস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি কমরেড লেনিনের মৃত্যুর পর রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির হাল ধরেন কমরেড স্ট্যালিন। তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আলোকে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পরিচালনা করেন। স্ট্যালিন কমরেড লেনিনের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা এবং যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী জিনোনিয়েভ-কামোনেভ, বুখারিন এবং বামপন্থী হঠকারী ট্রটস্কির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রাম পরিচালনা করে লেনিনবাদকে প্রতিষ্ঠা ও অগ্রসর করে কমরেড লেনিন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের যে রূপরেখা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করেণ। কমরেড স্ট্যালিন রাশিয়াতে মূলতঃ সমাজতন্ত্রকে রক্তমাংসে রূপ দেন। তিনি হচ্ছেন লেনিন নির্দেশিত পথে রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের রূপকার। স্ট্যালিন লেনিনবাদকে সংজ্ঞায়িত করে শ্রমিকশ্রেণীর পার্টির তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ইউরোপের পশ্চাৎপদ রাশিয়াকে বিশ্বের দ্বিতীয় শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেন। ১৯৩০-এর দশকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় দেখা দেয় মহামন্দা (Great depression)। অন্যদিকে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন ও বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়। এক্ষেত্রে জনগণের ক্রমবর্ধমান বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে উৎপাদন, পরিকল্পিত অর্থনীতি এবং জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্যপূর্ণ সমানুপাতিক বিকাশের নিয়ম (The economic law of balanced & proportionate development) কার্যকরী করা হয়। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে উৎপাদন সামাজিক কিন্তু মালিকানা ব্যক্তিগত। এখানে উৎপাদনের লক্ষ্য হচ্ছে সর্বোচ্চ মুনাফা, বিরাজ করে প্রতিযোগিতা ও নৈরাজ্য। ১৯৩৬ সালের ২৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সোভিয়েতের বিশেষ কংগ্রেসে (Extraordinary congress) কমরেড স্ট্যালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়নের খসড়া সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়। এই খসড়া সংবিধান উপর বিশেষ কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপোর্টে কমরেড স্ট্যালিন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রধানত (In the main) সমাজতন্ত্র অর্জিত হওয়ার কথা বলেন।
বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের ফ্যাসিবাদের বিপদ ঘনিয়ে এলে ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়। ১৯৩৫ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে গৃহীত কমরেড স্ট্যালিনের পরিচালনায় ডিমিট্রভ থিসিস, যার আলোকে পরিচালিত হয় বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার জনগণ, তাদের বাহিনী লালফৌজ মহান দেশপ্রেমিক যুদ্ধ (Great patriotic war)-এর মধ্য দিয়ে হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৫ সালের ৯ মে হিটলারের বাহিনী আত্মসর্মপণ করে লালফৌজের কাছে। প্রমাণিত হয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তি পূর্ব ইউরোপের ৭টি দেশের ক্ষমতা দখল করে প্রতিষ্ঠা করে জনগণতন্ত্র। এশিয়াতেও শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে কয়েকটি দেশে জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ও শিবির শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত হয়। এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয়। সূচিত হয় পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের দ্বিতীয় পর্যায় (2nd phase of general crisis of capitalism)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪৩ সালে তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে দেওয়া হয়। বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ১৯৪৭ সালে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে কমরেড স্ট্যালিনের পরিচালনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কমিনফর্ম (COMMINFORM – Communist international information bureau) গঠন করা হয়। কমিনফর্মের মুখপত্রের নাম দেওয়া হয় ‘চিরস্থায়ী শান্তির জন্য, জনগণতন্ত্রের জন্য’ (For a lasting peace, for a people’s democracy) রাখা হয়। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম এবং এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম মিলিত হয়ে বিপ্লবী সংগ্রামের এক মহাপ্রবাহ সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ তার শোষণ-শাসন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে গ্রহণ করে নয়াউপনিবেশবাদের কৌশল। সাম্রাজ্যবাদ তার প্রশিক্ষিত বিশ্বস্ত দালালদের ক্ষমতায় এনে পর্দার আড়ালে অবস্থান গ্রহণ করে।
এ সময়কালে কমরেড স্ট্যালিনকে আল ব্রাউডার ও টিটো মার্কা সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করতে হয়। সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়ে ‘দুর্গের ভেতর থেকে দুর্গ দখল’-এর কৌশল তথা সংশোধনবাদের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার কৌশল তীব্রতর করে। ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ কমরেড স্ট্যালিনের মৃত্যুর পরে পার্টির মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা সংশোধনবাদী ক্রুশ্চেভ চক্র পার্টি ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ১৯৫৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে তিন শান্তির তত্ত্বÑ “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান”, “শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা” ও “শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ” সামনে এনে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণে পূর্ব ইউরোপের জনগণতান্ত্রিক দেশগুলো পুঁজিবাদের পথ ধরে। চীনে ১৯৪৯ সালে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত হলেও গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপান্তরের সময়কালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও মাও সেতুং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হওয়ায় তথা সংশোধনবাদী মাও সেতুং চিন্তাধারার প্রভাবে চীনও পুঁজিবাদের পথ ধরে। ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ চক্র রাশিয়াকে পরিণত করে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদে, দুই পরাশক্তির এক পরাশক্তিতে। এরই ধারাবাহিকতায় সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় গর্বাচেভ চক্র “পেরেস্ত্রইকা” তথা পুনর্গঠন এবং “গ্লাসনস্ট” তথা খোলানীতি অনুসরণের মাধ্যমে ১৯৯১ সালে পুঁজিবাদের নগ্ন পরিণতিতে পৌঁছে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৫টি দেশে পরিণত হয়, পরাশক্তি হিসেবে তার পতন ঘটে। সমাজতন্ত্রের সাইনবোর্ড, নাম-নিশানা ছুঁড়ে ফেল ইয়েলেৎসিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া নগ্ন পুঁজিবাদ অনুসরণ করে চলে। ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক আলবেনিয়ায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে পৃথিবীতে আর কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ থাকে না।
রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের কায়দায় তুলে ধরে ‘সমাজতন্ত্র ব্যর্থ”, “মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ব্যর্থ” বলে বিশ্বব্যাপী প্রতিবিপ্লবী প্রচারাভিযানের ঝড় তোলে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, উপরোক্ত ঘটনাবলি সমাজতন্ত্রের সংকট নয় বরং তা হচ্ছে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত পুঁজিবাদের সংকট ও তার উলঙ্গ পরিণতি। এসব ঘটনাবলি থেকে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণীকে গ্রহণ করতে হবে গভীর শিক্ষা।
’৭০-এর দশকে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা দেখা দেয় অর্থনৈতিক সাধারণ সংকটের আরেকটি পর্যায়। অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে মুদ্রা বিনিময় হারের ক্ষেত্রে ব্রিটেন-উডস্ ব্যবস্থার পরিবর্তে ডলারভিত্তিক ‘স্বর্ণ বিনিময় মান’ (Dollar based gold exchange standard) এবং ১৯৭৩ সালে “ভাসমান বিনিময় হার” (Floating exchange rate system) ইত্যাদি নতুন পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৯০-৯১ সালে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের পতনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একক পরাশক্তিতে পরিণত হয় এবং “এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা” (Uni-polar world system) শ্লোগান সামনে আনে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়নের শ্লোগান আরো জোরেশোরে তুলে ঢালাও শোষণ-লুন্ঠন চালানোর ফলে সম্পদ ও পুঁজি আরো কেন্দ্রীভূত হওয়ার ফলশ্রুতিতে ধনী আরো ধনি এবং গরিব আরো গরিব হয়। বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেক্ষিতে শিল্পক্ষেত্রে বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যক্তিমালিকানা নীতি, কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও ব্যক্তিমালিকানায় বিপণন নীতি, অবাধ বাণিজ্য নীতি ও অবাধ মুদ্রানীতি কার্যকরী করে চলে। বিশ্বায়নের শ্লোগান সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল ও সংশোধনবাদীরা নানা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে প্রতিবিপ্লবী লক্ষ্য অর্জনে সক্রিয় থাকে। বিশ্বায়ন নতুন কোন বিষয় নয়, বরং ৯০-এর দশকে এটা হচ্ছে একচেটিয়া তথা লগ্নিপুঁজির আরো একচেটিয়াকৃত ও আন্তর্জাতিকীকরণকৃত এক অবস্থা। অথচ সাম্রাজ্যবাদ, প্রতিক্রিয়াশীল ও বিভিন্ন রূপের সংশোধনবাদীরা এর ভুল ও বিভ্রান্তিমূলক প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা প্রদান করছে। এই প্রক্রিয়ায় আশির দশকে “কাঠামোগত সামঞ্জস্যবিধান কর্মসূচি” (SAP)-এর ধারাবাহিকতায় ১৯৮৬ সালে “কাঠামোগত সামঞ্জস্যবিধান সুবিধা” (SAF) ও ১৯৮৭ সালে “বর্ধিত কাঠামোগত সামঞ্জস্যবিধান সুবিধা” (ESAF) সামনে এনে ১৯৯৩ সালে তা বর্ধিত করে ১৯৯৬ সালে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়। বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণকে বিভ্রান্ত করে সাম্রাজ্যবাদ ও তার বিশ্ব সংস্থাসমূহ তাদের নির্মম শোষণ-লুন্ঠন, শাসন, আধিপত্য বজায় রাখার জন্য দারিদ্র দূরীকরণের শ্লোগান কাজে লাগাচ্ছে। অথচ শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের দুঃখ-কষ্ট, দারিদ্র, বেকারত্ব ইত্যাদির জন্য দায়ী মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদ। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা রক্ষা করা, তাদের শোষণ-লুন্ঠন তীব্রতর করা এবং বিপ্লব ঠেকানোর লক্ষ্যে জনগণকে প্রতারিত করার জন্য তারা আনছে সংস্কারমূলক কিছু বুলি ও কর্মসূচি। এ প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে সামনে আনা হয় ‘দারিদ্র বিমোচন ও প্রবৃদ্ধি সুবিধা’ (PRGF) এবং ২০০০ সালে জাতিসংঘ ৮টি লক্ষ্য সম্বলিত ‘সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য’ (MDG)। এমডিজি কার্যক্রমের মেয়াদ শেষে ২০১৫ সালে সামনে আনে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য’ (SDG)। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭টি লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় নতুন নতুন আবিষ্কার ঘটে চলেছে। তবে সাম্রাজ্যবাদীরা সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু কাজে লাগাচ্ছে। বাকিটা তারা আটকে রাখছে। বিজ্ঞানকে তারা জনকল্যাণের পরিবর্তে আগ্রাসী যুদ্ধ ও ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করছে। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষসহ সর্বস্তরে তারা তীব্র অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নব নব আবিষ্কারের কথা বলে, বিশ্বে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলে, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের লেজুড় সংশোধনবাদীরা শ্রমিকশ্রেণীর বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজ বিপ্লব তথা সর্বহারা বিপ্লবের বিজ্ঞান মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অচল হয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিশ্বে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলেও বিশ্ব পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তন ঘটলেও কোন মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগ অব্যাহত আছে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দিকনির্দেশনা, কার্যকারিতা ও প্রাসঙ্গিকতা অব্যাহত আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিতে ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থা তথা উৎপাদন সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে।
’৭০-এর দশকে সূচিত সাধারণ সংকটের এ পর্যায়ে ৯০-এর দশকে ১৯৯৪ সালে মেক্সিকোতে সংঘটিত ধস ও মন্দা, ১৯৯৭-৯৮ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও প্রাচ্যের দেশসমূহের ধস; ১৯৯৮ সালে রাশিয়ার ধস; ১৯৯৯ সালে ল্যাটিন আমেরিকার ব্রাজিলের ধস্ ইত্যাদি ধস্ সংঘটিত হওয়ার ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ধস নামে, যা ‘ডট কম ক্রাস’ (Dot com crash) নামে পরিচিত। ২০০১ সালে মার্কিন শেয়ারবাজারে ধস নামার মধ্য দিয়ে মন্দা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের মন্দা ২০০৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বৈশ্বিক মন্দায় পরিণত হয়। বৈশ্বিক মন্দা মোকাবেলায় বিভিন্নমূখি ও সামগ্রিক তৎপরতা চালিয়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দাবী করলেও কার্যত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দা বিভিন্ন রূপে কার্যকরী থাকে।
চলমান বৈশ্বিক সংকটে ও মন্দার মূল কারণ যে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরে নিহিত এবং অতিউৎপাদন সংকট (Crisis of over production), সেই সত্যকে আড়াল করে। এটা মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় অতিউৎপাদন নয় বরং তাদের ক্রয় ক্ষমতার তুলনায় অতিউৎপাদন। অতিউৎপাদন সংকটের অর্থ হলো বিক্রির কমতি, বাজারের সংকোচন, বিনিয়োগ ও উৎপাদন হ্রাস এবং উৎপাদন ক্ষমতার ক্রমান্বয়ে আংশিক ব্যবহার। ফলে বৃদ্ধি পায় ক্রমাগত শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাই ও বেকারত্ব। কলকারখানা, আর্থিক ও ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ দেউলিয়াত্ব ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের অবনতি, শেয়ারবাজারের ধ্বস ঘটতে থাকে, অর্থনীতিতে দেখা দেয় নৈরাজ্য। তারা আড়াল করে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্য তথা উৎপাদন সামাজিক, মালিকানা ব্যক্তিগত; সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন; ধনী আরো ধনী এবং গরিব আরো গরিব হওয়া তথা বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী ও জণগনের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস; অনুৎপাদনশীল, অবক্ষয়ী ও ধ্বংসাত্মক খাতে তথা সামরিক খাত, মাদক ব্যবসা, পর্ণোগ্রাফি ও ফাটকাবাজি, শেয়ার বাজারে একচেটিয়া তথা লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগের বিপুল বৃদ্ধি; অসমান বিকাশের নিয়মে পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় বন্টিত বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বণ্টন যুদ্ধ তথা বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি পায়। সাম্রাজ্যবাদীরা আগ্রাসী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সংকট উত্তরণে অর্থনীতির সামরিকীকরণ ও যুদ্ধ অর্থনীতি জোরদার করে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সূচিত অর্থনৈতিক সংকট ও মন্দার ফলশ্রুতিতে বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বন্টনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮)। ত্রিশের দশকের মহামন্দার পরিণতিতে ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-৪৫)। চলমান বৈশ্বিক মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পরিণতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
মার্কস ও লেনিন ধারাবাহিকভাবে শিক্ষা দিয়েছেন যে, শ্রমিকশ্রেণী বুর্জোয়া শ্রেণীকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত করলেও বুর্জোয়া শ্রেণী আরও মরিয়া হয়ে তাদের হারানো স্বর্গ ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে ও প্রচেষ্টা শতগুণ তীব্রতর করে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আমাদের শিক্ষা দেয় যে, সাম্যবাদের দুইটি স্তর- নিম্নতর স্তর ও উচ্চতর স্তর। কমিউনিজমের নিম্নতর স্তর হলো সমাজতন্ত্র। নি¤œতর স্তরে শোষণের অবসান হয়, কার্যকর থাকে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ, কাজ অনুযায়ী প্রাপ্য (According to ability, according to work)। আর কমিউনিজমে কার্যকরী থাকে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ, প্রয়োজন অনুযায়ী প্রাপ্য (According to ability, according to need)। পুঁজিবাদের গর্ভ থেকে যে সমাজ জন্মগ্রহণ করে তাতে অর্থনৈতিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক সকল ক্ষেত্রে পুরানো সমাজের জন্মচিহ্ন থেকে যায়। সর্বহারা একনায়কত্বাধীন সমাজতন্ত্রে এই জন্মচিহ্ন দূর করার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চলে। তবে এই স্তরে তা পুরোপুরি দূর হয় না। তাই কোন সমাজতান্ত্রিক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণকালে এমনকি সমাজতন্ত্র মূলতঃ প্রতিষ্ঠিত হলেও বুর্জোয়া জন্মচিহ্নের প্রেক্ষিতে বুর্জোয়া অধিকারবোধ (Bourgeois right) আংশিকভাবে রয়ে যায়। তাছাড়া মানসিক, সাংস্কৃতিক ও ভাবাদর্শগত ক্ষেত্রে অসর্বহারা মতাদর্শ ও তার প্রভাবের সূক্ষ্মতর ও সময়সাপেক্ষ দিকসমূহ থাকে। সমাজতান্ত্রিক দেশ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী পরিবেষ্টনীর মধ্যে থাকায় পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বাহ্যিক কারণসমূহ রয়ে যায়। কার্ল মার্কস বলেন, “পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিস্ট সমাজের মধ্যবর্তী পর্যায়ে রয়েছে একটা থেকে আরেকটার বৈপ্লবিক রূপান্তরের পর্যায়। এর সাথে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে, একটি রাজনৈতিক উত্তরণকালীন সময়, যেখানে রাষ্ট্র সর্বহারা শ্রেণীর বৈপ্লবিক একনায়কত্ব ছাড়া অন্যকিছু হতে পারে না।” বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের বিজয় নির্ণায়ক স্তরে না যাওয়া পর্যন্ত একটি দেশে সর্বহারা একনায়কত্বাধীনে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণ চললেও, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা মূলতঃ প্রতিষ্ঠিত হলেও, পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণ এবং শর্ত বিদ্যমান থাকে। তাই কোন সমাজতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ঘটনা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বেঠিকতা প্রমাণ করে না, বরং পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার কারণ, উৎস ও নিয়ম সম্পর্কে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী ব্যাখ্যা ও বক্তব্যের সঠিকতা তুলে ধরে এবং ভবিষ্যতে কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে বিপ্লবী কর্তব্য ও দিক-নিদের্শনা দেয়। তাই পুঁজিবাদ থেকে কমিউনিজম পর্যন্ত গোটা ঐতিহাসিক পর্যায় জুড়ে সর্বহারা একনায়কত্বাধীনে শ্রেণী সংগ্রামকে তীব্রতর করতে হয় সকল ফ্রন্টে সকল দিকে। কোন একদিকে তা দুর্বল হলে সে পথ দিয়ে পুঁজিবাদের প্রভাব বাড়বে, পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। সকল ক্ষেত্রে সকল প্রশ্নে তাত্ত্বিকভাবে সংশোধনবাদের সকল প্রকাশকে পরাস্ত করাটা তাই মৌলিক প্রশ্ন। অন্যথায় সংশোধনবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে, ক্ষমতা দখল করবে বুর্জোয়া শ্রেণী, প্রতিষ্ঠিত করবে বুর্জোয়া একনায়কত্ব। সুতরাং সংশোধনবাদ ও পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও বিনির্মাণকালে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিপদকে মোকাবিলা করা যায়।
আজ পৃথিবীতে কোন সমাজতান্ত্রিক দেশ নেই, ফলে বিশ্বে আজ কার্যকর রয়েছে তিন মৌলিক দ্বন্দ্ব। তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে মনে রাখতে হবে ১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর বিপ্লবপূর্ব তিন মৌলিক দ্বন্দ্ব কার্যকর থাকার পরিস্থিতির সাথে বর্তমান পরিস্থিতির রয়েছে পার্থক্য। এ সময়ে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বিজয়, সমাজতান্ত্রিক বিনির্মাণের মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। সুতরাং আগামীতে শ্রমিকশ্রেণী এ মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাকে সামনে রেখে আরো সচেতন ও সতর্ক থেকে, আরো অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে কমিউনিজমের সুমহান লক্ষ্যে অগ্রসর হবে।
সমগ্র পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় এ পর্যায়ের চলমান বৃহত্তম ও গভীরতম বৈশ্বিক মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে ১০ বছর পড়লেও পরিত্রাণ পাওয়া তো দুরের কথা, বরং আঁকাবাঁকা গতি পথে তা আরো ঘনীভূত হয়ে মহামন্দার বিপদ সংকেত ধ্বনিত হচ্ছে। তিন মৌলিক দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে একদিকে বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বণ্টন নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধ বিস্তৃত হয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করে চলেছে, অন্যদিকে দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম, বিদ্রোহ-বিপ্লব তথা বিশ্ববিপ্লবের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। মন্দা থেকে উদ্ধার পেতে সাম্রাজ্যবাদীরা একদিকে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের ওপর শোষণ-লুন্ঠন তীব্রতর করে জনগণের অর্থে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে চলেছে। সংকটের বোঝা আরো বেশি বেশি করে জনগণের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে মজুরী, বেতন, পেনশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ জনকল্যাণ খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়ে ছাঁটাই, বেকারত্ব, করের বোঝা বৃদ্ধি করে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণকে নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট, আরো দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করছে। শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্ব সুতীব্র হওয়া এবং একচেটিয়া পুঁজির তীব্রতর আক্রমণ মোকাবেলায় আমেরিকা, ইউরোপসহ পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোসহ বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক, যুবক, জনতা বিভিন্ন রূপে আন্দোলন, বিক্ষোভ-সমাবেশ, ধর্মঘট-সাধারণ ধর্মঘট তীব্রতর করে চলেছে। দেশে দেশে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী সংস্থাসমূহের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই সব আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার আরো বেশি বেশি হরণ করে সন্ত্রাস দমনের নামে বিভিন্ন কালাকানুন জারি করছে। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের অর্থে একচেটিয়া তথা লগ্নিপুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী ব্যাংক, আর্থিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান উদ্ধারকল্পে উদ্ধার কর্মসূচি (Bail out), চাঙ্গাকরণ (Stimulus) কর্মসূচী, পরিমাণগত সহজীকরণ কর্মসূচি (QE), কৃচ্ছ্রসাধনের (Austarity) কর্মসূচি, অ্যাবে অর্থনীতি, ঋণাত্মক সুদের হার (Negative interest rate) ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে চল্লেও মন্দা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অসমান বিকাশের নিয়মে পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেন উডস্ সম্মেলনে গঠিত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, গ্যাট (পরবর্তীত ডব্লিউটিও), জি-৭, জি-৮ ইত্যাদির কার্যকারিতা হারাতে থাকলে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্পর্কে পুনর্বিন্যাস ও পুনর্মেরুকরণ প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক বৈশ্বিক প্রধান ফোরাম হিসেবে সামনে আসে জি-২০; বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর সংস্কার, কোটা, ভোটাধিকার, ইউয়ানকে এসডিআর-এর ঝুড়িতে অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি বিষয়। মন্দা থেকে বের হতে তারা গ্রহণ ও অগ্রসর করে চলে আগ্রাসী যুদ্ধ। অসমান বিকাশের নিয়মে পুঁজি ও শক্তির অনুপাত পরিবর্তিত হওয়ায় বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বন্টনকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যযুদ্ধ, মুদ্রাযুদ্ধ, স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধ বিস্তৃত করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ ও সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে চলেছে। একক পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ, প্রি-এম্পটিভ ওয়ার (Pre-emptive war), আমেরিকান ব্যতিক্রমবাদ (American exceptionalism), একপাক্ষিকতাবাদ (Unilateralism), রিজিম চেঞ্জ (Regime change) ইত্যাদি মতবাদ ও শ্লোগান সামনে রেখে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ায় আগ্রাসন ও দখলের ধারাবাহিকতায় তাদের সৃষ্ট আইএস দমনের নামে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে নতুন কৌশলে তাদের প্রভাববলয় বিস্তৃত করার জন্য ইরাক, সিরিয়া যুদ্ধ সংগঠিত করে। প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়াকে মোকাবেলা করার জন্য ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ এবং ইউরোপের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পূর্ব ইউরোপ ও বাল্টিক অঞ্চলে ব্যাপক সমরসজ্জা ও সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত করে চলে। আবার বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে পুঁজিবাদী চীনকে মোকাবেলায় ‘এশিয়া-প্যাসিফিক রণনীতি’ তথা ‘রিব্যালান্সিং টু এশিয়া’ বা ‘পিভট টু এশিয়া’ রণনীতি কার্যকরী করে এতদ্বঞ্চলে ব্যাপক সমরসজ্জা ও সামরিক মহড়া করে চলে। এই রণনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী জাপান ও নয়াউপনিবেশিক-আধাসামন্তবাদী ভারতকে সমন্বিত করে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান আঞ্চলিক শক্তি ভারতকে চীনের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে গড়ে তুলতে বাৎসরিক মালাবার সামরিক মহড়া করে চলাসহ লেমোয়া (LEMOA- Logistic exchange memorandum of agreement) সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। উত্তর কোরিয়ার মিসাইল ও পারমাণবিক বোমা পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে এতদ্বঞ্চলে তীব্র যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি করে। আফগানিস্তানে যুদ্ধের প্রেক্ষিতে নতুন প্রতিরক্ষা নীতি ঘোষণা করে সেনা প্রেরণ বৃদ্ধি করে। এতদ্বসত্ত্বেও মন্দা থেকে বের হতে না পারা এবং মহামন্দার লক্ষণসমূহ আরো সামনে চলে আসায় আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী শক্তি সম্পর্কের ক্ষেত্রে অধঃগতি সত্ত্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব, আধিপত্য ধরে রাখার লক্ষ্যে সামনে আনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মার্কিন একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষা ও অগ্রসর করতে মার্কিন সরকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় বিন্যাস পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে বিভিন্ন কৌশলে লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট। “যুক্তরাষ্ট্র প্রথম (America first)”, “আমেরিকাকে আবার বৃহৎ করে তোলা (To make America great again)” এবং “Buy America hire America” ইত্যাদি শ্লোগান সামনে রেখে সংরক্ষণবাদ তথা বাণিজ্য যুদ্ধ তীব্রতর করে অধিকতর সুযোগ-সুবিধা আদায়ের তৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মার্কিন সামরিক শক্তির প্রাধান্য ধরে রাখতে সামরিক শক্তি ও সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করে ডোনাল্ড ট্রাম্প অগ্রসর হয়। প্রতিপক্ষ রাশিয়া-চীনের সাথে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি ছাড়াও মার্কিনের সাথে তার পাশ্চাত্যের মিত্রদের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব, বাণিজ্যযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব সামনে আসছে। ব্রেক্সিট হওয়ার পর জার্মান-ফ্রান্সের নেতৃত্বে ২৭-জাতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউরোপীয় বাহিনী গঠনের ঘোষণা দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে, যা মার্কিনের সাথে ইউরোপের দ্বন্দ্ব এবং ন্যাটো জোটের অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শীর্ষ সম্মেলনে এর প্রতিফলন ঘটছে।
একক পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবেলায় সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া তার হারানো স্বর্গ ফিরে পাওয়া, নিকটবর্তী রণনীতিকে বিস্তৃত করে বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা, বিদেশে রুশ সামরিক ঘাঁটি বৃদ্ধি, সিস্ (CIS)-সিস্টো (CSTO), ইউরেশীয় ইউনিয়ন (EaEU) ইত্যাদি পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে পুঁজিবাদী চীনের ২০২০ সালের মধ্যে মোটামুটি সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার লক্ষ্য, ‘বেল্ট ও রোড উদ্যোগ’ (BRI), দুই মহাসাগর রণনীতি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্দ্ধমান সামরিক ভূমিকা, ‘এশিয়া অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক’ (AIIB) ইত্যাদি অগ্রসর করে চলেছে। আবার রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO), আঞ্চলিক সন্ত্রাসবিরোধী কাঠামো (RATS), ব্রিকস্ (BRICS), নতুন উন্নয়ন ব্যাংক (NDB), রিক (RIC), সিকা (CICA) ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। একই সাথে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (SCO) ভারত ও পাকিস্তানকে পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়া হয়। মার্কিনের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য ইউক্রেনে রুশপন্থী প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করলে সেই অজুহাত দেখিয়ে রাশিয়া ক্রিমিয়ায় গণভোট কৌশলে রুশভুক্তি করাসহ কৃষ্ণ সাগরে নৌবহর ও সেবাস্তোপোল নৌঘাঁটি শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করে এবং পাশ্চাত্যের পাল্টা ব্যাপক সামরিক মহড়া করে চল্লে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধোন্মাদনা অব্যহত থাকে। সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়া তার দালাল আসাদ সরকারের পক্ষে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আল-নুসরা ফ্রন্ট ও আইএসসহ ইসলামী জঙ্গীদের বিরুদ্ধে বিমান ও মিসাইল আক্রমণ শুরু করে। এই প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়ে আলেপ্পো পুর্নদখলের মধ্যে দিয়ে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি পায় ও অগ্রগমন এবং শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে। রাশিয়ার উদ্যোগে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অগ্রসর করার জন্য তুরস্ক ও ইরানকে নিয়ে গঠিত ত্রিপক্ষীয় ঘোষণায় তার প্রতিফলন ঘটে।
গোটা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় চলমান কার্যকর অর্থনৈতিক মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মহামন্দার দিকে ধাবিত হওয়া প্রমাণ করছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সঠিকতা। তিন মৌলিক দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী বিকশিত চমৎকার বস্তুগত বিপ্লবী পরিস্থিতিকে বিপ্লবে পরিণত করতে হলে সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন হচ্ছে, বিপ্লবের আত্মগত শক্তি তথা সকল রূপের সুবিধাবাদ ও সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে ও রীতি-নীতিতে গড়ে ওঠা বলশেভিক ধরনের শ্রমিকশ্রেণীর পার্টি এবং সে পার্টির নেতৃত্বে প্রয়োজনীয় সকল হাতিয়ার। সকল রূপের সংশোধনবাদ তথা ট্রটস্কিবাদ, টিটোমার্কা, ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ-গর্ভাচভ মার্কা, ইউরো কমিউনিজম মার্কা, মাওবাদ মার্কা, জুচে ভাবধারা মার্কা, পুঁজিবাদী চীনকে সামনে রেখে ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া ও কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক আখ্যায়িত করা ইত্যাদি সকল রূপের সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন আদর্শগত সংগ্রাম চালানোটা হচ্ছে বিপ্লবকে জয়যুক্ত করার অপরিহার্য শর্ত। ইতোমধ্যে টিটোমার্কা, ক্রুশ্চেভ-ব্রেজনেভ-গর্ভাচভ মার্কা, মাওবাদ মার্কা সংশোধনবাদের স্বরূপ বাস্তব ঘটনার মধ্যদিয়ে উন্মোচিত ও বিপর্যস্ত হয়েছে। পুঁজিবাদী চীনকে সমানে রেখে ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া ও কিউবাকে সমাজতান্ত্রিক দেশ আখ্যায়িত করে সংশোধনবাদী ধারা এবং রাশিয়া ও চীনসহ “আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভা” (IMCWP-International metteeing of communist & workers parties) মার্কা সংশোধনবাদ বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্য সর্বাত্মকভাবে তৎপর। এই ধারার সাথে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (CPB) ও ওয়ার্কার্স পার্টি সম্পর্কিত। এছাড়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ট্রটস্কিবাদ, মাওবাদ মার্কা, জুচে ভাবধারা মার্কা ইত্যাদিসহ বিভিন্ন রূপের সংশোধনবাদী ধারা কার্যকরী রয়েছে। আমাদের দেশেও অন্যান্য সংশোধনবাদী ধারা তৎপরতা রয়েছে। এ সকল সংশোধনবাদী-সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে আপোষহীন মতাদর্শিক সংগ্রাম অব্যাহত রেখে এদের স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে। রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকী পালনকে কেন্দ্র করে সকল প্রকার সুবিধাবাদ-সংশোধনবাদীদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শাণিত করে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণকে সচেতন করতে হবে। রুশ বিপ্লবের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের কুৎসা ও বিরোধিতাকে রুখতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ মানেই যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী যুদ্ধ ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবের অজেয় অমর শিক্ষাকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থি ছিন্ন করার ফল হিসাবে জয়যুক্ত করতে হবে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে পুঁজিবাদী দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং নয়াঔপনিবেশিক-আধাসামন্তবাদী দেশে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং অগ্রসর হতে হবে বিশ্ববিপ্লবের পথে, বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার সুমহান লক্ষ্যে। বিশ্বব্যাপী আসন্ন বিপ্লবী ঝড় ত্বরান্বিত করতে পৃথিবীর যে সকল দেশে প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি রয়েছে তাকে শক্তিশালী করা; যে সব দেশে প্রকৃত কমিউনিস্ট পার্টি নেই সে সব দেশে পার্টি গড়ে তোলা; বিশ্বব্যাপী প্রকৃত কমিউনিস্ট ঐক্য ও সে জন্য একটি ফোরাম গড়ে তোলা অপরিহার্য। সাথে সাথে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণী তথা প্রকৃত কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সকল সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-লুন্ঠন, আগ্রাসন-দখল, সন্ত্রাস, দমন-পীড়ন, ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সকল শক্তি, সংগঠন, ব্যক্তিদের নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা জরুরী প্রয়োজন। কার্ল মার্কস কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহারে ঘোষণা করেন যে, “বুর্জোয়াদের পতন এবং সর্বহারাদের বিজয় দুই সমান অনিবার্য।” “যে অস্ত্রগুলো তার মৃত্যু আনে বুর্জোয়া শ্রেণী শুধু সেগুলি নির্মাণই করেনি বরং তারা এমন লোকও সৃষ্টি করেছে যারা সে অস্ত্রই পরিচালনা করবে। তা হচ্ছে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণী, সর্বহারা শ্রেণী।”; “তাই বুর্জোয়া শ্রেণী সৃষ্টি করে তারই নিজের সমাধি খনকদের।” সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে মৌলিক দ্বন্দ্বগুলো তীব্রতর হয়ে বর্তমানে বৈশ্বিক মন্দা গভীরতর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে বস্তুগত বিপ্লবী পরিস্থিতি পরিপক্বতাজনিত পরিস্থিতিতে কার্ল মার্কসের উল্লিখিত ঐতিহাসিক ঘোষণা আরো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। “কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসক শ্রেণীরা কাঁপুক। শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারা শ্রেণীর হারাবার আর কিছু নেই, জয় করার জন্য আছে সারা বিশ্ব” (কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার)। বিশ্বব্যাপী কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে “আবশ্যিকতার রাজ্য থেকে স্বাধীনতার রাজ্যে” উল্লম্ফন ঘটবে। (কাল্পনিক ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, ফেডারিখ এঙ্গেলস)। তাই আমাদের মত স্বৈরতান্ত্রিক দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের নিষ্ঠুরতাকে মোকাবেলা করতে গেলে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল বিরোধী সকল শ্রেণী, সংগঠন, ব্যক্তি ও গোষ্ঠিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে অগ্রসর হওয়া। সংগ্রাম করতে সাহসী হোন, বিজয় অর্জন করতে সাহসী হোন। পথ আঁকাবাঁকা, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
সংগ্রামী অভিনন্দনসহ
মহান রুশ বিপ্লবের শততম বার্ষিকী উদযাপন কমিটি।
স্থান ঃ প্রেস ক্লাব মিলনায়তন, যশোর ।
তারিখ ঃ ১৮ নভেম্বর ২০১৭ শনিবার।
সময় ঃ বিকাল ৩টায়।