৩০ মার্চ ২০১৮ শুক্রবার শ্রমিকনেতা আলী হায়দারের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।
জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম জেলা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শেখ আলী হায়দার (৫৬)’র অকাল মৃত্যুবরণ করেন ৩০ মার্চ ২০১৫।
শেখ আলী হায়দার ১৯৫৯ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর বাগেরহাট জেলার সদর থানার দেওয়ানবাটি গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাহার পিতার নাম মৃত আলহাজ্ব শেখ মনতাজ উদ্দীন, মাতা মর্জিনা বেগম। নয় ভাই ও দুই বোন, ভাইদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। শিক্ষাজীবনে প্রথমে রুহুল আমিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে এসএসসি পাশ এবং ১৯৭৬ সালে প্রফুল্ল চন্দ্র সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ১৯৭৮ সালে একই গ্রামের মোছাম্মৎ দেলোয়ারা বেগমের সাথে প্রণয়াবদ্ধ হন এবং তাকে সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি ইস্পাত কারখানায় মাস্টারস টেকনিশিয়ান পদে শ্রমিকের চাকুরি নেন এবং তাঁর স্ত্রী মোছাম্মৎ দেলোয়ারা বেগম উক্ত মিলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকুরি নেন। চাকুরি জীবনের পাশাপাশি উভয়ে পড়ালেখাও চালিয়ে যান। শেখ আলী হায়দার ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি.এ পাশ এবং ১৯৮৮ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করেন। একই সনে তাঁর স্ত্রী ইসলামের ইতিহাস থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।
শেখ আলী হায়দারের কর্মজীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তিনি ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানায় শ্রমিকের চাকুরি নেন, পরে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে ২০০১ সালে দৈনিক ঈশান ও সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকায় সাংবাদিকাতার চাকুরি নেন এবং ২০১২ সালে দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি ও চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ হিসাবে চাকুরিতে যোগদান করেন, ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ (মৃত্যুর পূর্বক্ষণ) পর্যন্ত উক্ত পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, চট্টগ্রামে ১৯৮১ সালের দিকে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-দালাল পুঁজি বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে অগ্রসর করে নেওয়ার লক্ষ্যে শ্রমিক-কৃষক-জনগণকে সংগঠিত করে সংগ্রাম-সংগঠনের কাজে যারা সক্রিয় নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল তাদের সাথে তার যোগাযোগ গড়ে উঠে। তারই ধারবাহিকতায় তিনি বিপ্লবী ধারার শ্রমিক সংগঠন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে তিনি চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানায় শ্রমিকদের সংগঠিত করার পাশাপাশি বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের নীতি আদর্শের প্রেক্ষিতে ডক, বন্দর, ষ্টিভিডোরিং, মার্চেন্ট সেক্টরে সংগঠন-সংগ্রামকে গড়ে তোলার জন্য সক্রিয় ছিলেন।
১৯৯১ সালে ষ্টিভিডোরিং শ্রমিক ও বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ চট্টগ্রাম জেলার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, প্রয়াত মাঈনউদ্দিন আহমদসহ ৪ জন বন্দর শ্রমিক নেতার চাকুরী পুনর্বহালের দাবিতে লাগাতার অনশন আন্দোলন এক পর্যায়ে বন্দর অচল করে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে অগ্রণী ও সাহসী ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ইব্রাহিম টেক্সটাইল, পাহাড়তলী টেক্সটাইল, করাতকল, রিক্সা, হোটেল, মিষ্টি বেকারী, গার্মেন্টস, ইপিজেড, লাইটারেজ, মৎস্য তথা নৌযানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংগঠন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের ১ম জেলা সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বৎসরে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও আমলা-মুৎসুদ্দি পুঁজি বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) এর ১ম কর্মী সম্মেলনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানার সিবিএ নির্বাচনে তিনি সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯২-৯৩ সালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট চট্টগ্রাম জেলার সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি উক্ত দায়িত্ব পালন করেন এবং পেশাগত কারণে উক্ত পদ থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিলেও আমৃত্যু তিনি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট চট্টগ্রাম জেলার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে শেখ আলী হায়দার অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন, ৮ ঘন্টা কাজ সহ শ্রম আইন বাস্তবায়নে স্বৈরাচারী এরশাদের সময়ে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ৫ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ এর নীতি নির্দেশ অনুযায়ী মিল কলকারখানা বিরাষ্ট্রীয়করণ বন্ধ ও বন্ধ কলকারখানা চালু করার আন্দোলন, ২০০০ সালে বেপজা সার্কুলার অনুযায়ী ইপিজেড শ্রমিকদের মজুরি প্রদান ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং আন্দোলনের নেতা হিসাবে সরকার কর্তৃক জননিরাপত্তা মামলার আসামী হয়ে হুলিয়া মাথায় নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যান। ২০০৬ সালে গার্মেন্টস শ্রমিক আন্দোলন করার কারণে দ্রুত বিচার আইন মামলার আসামী এবং পরবর্তীতে র্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার হন।
হোটেল, নৌযান, মিষ্টি বেকারী, মৎস্য, জুট টেক্সটাইল সেক্টর, কেমিক্যালসহ চট্টগ্রামের প্রতিটি শ্রমিক আন্দোলনে শ্রমিকদের পাশে থেকে নিরলস ও আপোসহীন সংগ্রাম পরিচালনা করেন। আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণের পায়তারার বিরুদ্ধে আন্দোলন, আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আগ্রাসন বন্ধ আন্দোলন, সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্র ঘেরাও আন্দোলন, এসএস পোর্ট বিরোধী আন্দোলন, ক্লিনটন আগমন প্রতিরোধ আন্দোলনসহ সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দালাল স্বৈরাচারী এরশাদ, খালেদা, হাসিনা’র দুঃসাশন বিরোধী আন্দোলন ও শ্রমিক-কৃষক জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ক্ষেত্রে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র, পেশাজীবীসহ সকল জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন সংগ্রামে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এর নেতৃত্বের ভূমিকায় অগ্রণী থাকেন।
তিনি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলা-দালাল পুঁজি বিরোধী, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি ও নিপীড়িত জাতি ও জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান প্রতিষ্ঠায় আপোসহীন যোদ্ধা। ব্যক্তিগতভাবে সংকীর্ণতাবাদ, উদারতাবাদ, লেজুড়বাদ, সংশোধনবাদ, সন্ত্রাসবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী একজন সাম্রাজ্যবাদ বিরেধী দেশপ্রেমিক নেতা ছিলেন। তার মৃত্যু হলেও এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।