সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পপনায় জাতীয় স্বার্থ বিরোধী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ বন্ধ কর।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সংশ্লিষ্ট জনবসতি উচ্ছেদ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোল।
আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুন।
সংগ্রামী সাথী ও বন্ধুগণ
অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনারা জানেন সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার পরিকল্পনায় পাবনা জেলার ঈশ্বরদী রূপপুরে ১ হাজার মেগাওয়াট শক্তি সম্পন্ন দুইটি বিপদজনক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। পারমাণবিক বিদ্যুতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ক্ষতিকারক দিক থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ তথা দেশবাসীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এব্ং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার বেঁধে দেওয়া ৬৩ প্রকার প্রাক সমীক্ষার রির্পোট প্রকাশ ছাড়াই শুরু করতে যাচ্ছে প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার দলিলে নির্ধারণ করে দিয়েছে ২৫০ এবং ৫০০ মেগাওয়াট শক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২.৪ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এলাকা এবং পরে ৫ কিলোমিটার এলাকা ব্যাসার্ধ জুড়ে জন মানব শূণ্য করতে হবে। তারপর ১৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১০ হাজারের বেশি জনসংখ্যার বসতি থাকা চলবে না। আরো ৫ কিলোমিটার পরে ৫০ হাজারের বেশি বা ১ লাখের ওপরে জনবসতি থাকবে না। নতুন ইউনিট হলে এই এলাকার বসতি আরো দূরে সরিয়ে নিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানোর প্রয়োজন হবে। রূপপুরের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক দলিল অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ করে মানুষের বাড়িঘর উচ্ছেদের কার্যক্রম শুরু হবে এটাই স্বাভাবিক। তাহলে সরকার জেনে শুনে পাবনা ঈশ্বরদী, নাটোর, ভেড়ামারা ও কুষ্টিয়ার বিশাল অঞ্চলের প্রায় ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। আর কেনই বা সরকার জনগণের বিপুল অংকের ট্যাক্সের লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে এই ধরণের মহাবিপদজনক দানবকে দেশের জনগণের ঘাড়ে চাঁপিয়ে দিচ্ছে। যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তেজস্ক্রীয়তায় এ অঞ্চলের ২৫-৩০ কিলোমিটার এলাকার পরিবেশকে ধ্বংস করবে, কৃষি আবাদ, আম, লিচু, কাঁঠাল, শাক-সবজি, ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, মানুষের চাষের জমি কেড়ে নিবে, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করবে, নদীর পানিকে করবে দূষিত, আর সেটা বিস্ফোরিত হলে ঈশ্বরদী, পাবনা, নাটোর, কুষ্টিয়া জেলার ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে মহাবিপদ ও ধ্বংসলীলা সুষ্টি করবে।
মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা পারমাণু থেকে যে শক্তি পাওয়া যায় সেটাই পারমাণবিক শক্তি। এ শক্তি যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে বোমা বানিয়ে সভ্যতা ধ্বংষ করা এবং শান্তিপূর্ণ কাজ দু’ভাবেই ব্যবহার করা যায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার স্বীকৃত হলেও তাতে থাকে সমস্যা ও বিপদের আশংকা। মূলত ফিউশন প্রক্রিয়ায় পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন হয়। প্লুটোনিয়াম, থোরিয়াম ও নিউট্রন এর সাথে সংঘর্ষ করেই ফিউশন প্রক্রিয়া চালাতে হয়। এতে ৯০ ভাগ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। ইউরেনিয়াম প্রচুর পানি দিয়ে শোধন করতে হয়। ৬০এর দশকের শুরুতে প্রমত্ত পদ্মার অবাধ প্রবাহকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে রূপপুরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ৪০ কিলোমিটার উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার ফলে সেই পদ্মা এখন মৃত নদী। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ না থাকলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি চালু হবে না। সরকার বলছে সরকার বলছে পদ্মা শুকিয়ে গেলে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হবে, কিন্তু এতো বিপুল পরিমাণ পানি ভূ-গর্ভ থেকে উত্তোলন করা হলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে। মানুষের খাবার পানিসহ চাষাবাদের সেচের পানির মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হবে, ধ্বংস হবে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা। ভয়াবহভাবে আর্সেনিক দূষণ আরো বৃদ্ধি পাবে। এমনিতেই ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এ অঞ্চল। বিষাক্ত তেজস্ক্রীয়তা বাতাসে রেডিয়েশন হয়ে দূরাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে এবং প্রাণী দেহে স্থায়ী ক্ষতি করবে। শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ, ক্যান্সার ও জননতন্ত্রের বিরূপ প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়ে প্রাণীকূলের অকাল মৃত্যু ডেকে আনবে।
বন্ধুগণ
বর্তমানে সারা দুনিয়াতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৪৪০টির মত। এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দূর্ঘটনা ও বিপর্যয় ঘটেছে শতাধিকের মত। এ সব দূর্ঘটনা ও বিপর্যয়ের কারণে মানুষের প্রাণহানী, জীববৈচিত্র ধ্বংসসহ সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কয়েক শত বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। রূপপুরে রাশিয়ার তৈরি ভিভিইআর ১০০০ মডেলের অত্যাধুনিক থ্রী প্রযুক্তির চুল্লি বসানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি ও নকশার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, রাশিয়ার এই প্রযুক্তি ও নকশা নাকি ১৯৭০ এর দশকের ডিজাইনের সংশোধিত রূপ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। রাশিয়া দাবি করছে এ ধরণের চুল্লির দূর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই এবং ১০ মাত্রার ভূমিকম্প ও বিমানের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। রাশিয়ার চেরেনোবিল ধ্বংসলীলা ও ২০১১ সালের মার্চে জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু বিপর্যয় ও ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস বিশ্ববাসী জানে। কিন্তু তাদের এই প্রযুক্তির অনেক ধরণের ত্রুটি ও ঝুঁকি থাকার কারণে ইউরোপের অনেক দেশ এই ভিভিইআর ১০০০ প্রযুক্তির চুল্লি ক্রয়ের ১১টি চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। দেশগুলো হলো হাঙ্গেরীর ২টি, ইউক্রেন ৩টি, জার্মানীর ৪টি, চেক রিপাবলিক ২টি। ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যের কুডানকুলাম অঞ্চলে ঐ ভিভিইআর ১০০০ এর দুইটি চুল্লি ২০০৮ সালে বসানোর পর সেখানে জনগণের আন্দোলনের মুখে আজ পর্যন্ত চালু করতে পারেনি। এই চুল্লি বসালে এতদ্বাঞ্চলে আধুনিকীকরণ করা হবে, ১০ হাজার লোকের কর্ম সংস্থান হবে, জমি অধিগ্রহণ হবে না, বাড়িঘর উচ্ছেদ হবে না- এই ধরণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু জনগণ প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে যে কারণে আজ পর্যন্ত প্রকল্প চালু করতে পারেনি। এই তুরস্ক ও ভিয়েতনাম রাশিয়ার ঐ ভিভিইআর ১০০০ প্রযুক্তি নগদে ৩৩ হাজার কোটি টাকায় কিনে বিপদে পড়েছে। তারাও এই প্রযুক্তি রাশিয়ায় ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার ১.৫ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার কোটি টাকা) এতো সস্তা দামে তাও আবার বাকীতে রূপপুরে নির্মাণ করে দিবে- এটা কোন ধরণের অত্যাধুনিক থ্রী জি প্রযুক্তি?
সংগ্রামী সাথীরা
পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ২০০৮ সাল থেকে মন্দায় নিমজ্জিত হয়ে ৮ বছর অতিক্রম করলেও তা থেকে পরিত্রাণ না পেয়ে মন্দা থেকে মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে এর থেকে পরিত্রাণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পুঁজি ও শক্তির অনুপাতে বাজার ও প্রভাব বলয় বন্টন-পুনর্বন্টন ও সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে দেশে দেশে একচেটিয়া বা লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ প্রেক্ষিতে চলছে বাণিজ্যযুদ্ধ, মুদ্রাযুদ্ধ, স্থানীয়যুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে সংঘটিত হচ্ছে শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্ব। দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান আঞ্চলিক শক্তি নয়াউপনিবেশিক ভারতকে কেন্দ্র করে এতদ্বাঞ্চলে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব সুতীব্র। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নয়াউপনিবেশিক দেশসমূহে সাম্রাজ্যবাদের সাথে নিপীড়িত জাতি ও জনগণের দ্বন্দ্ব সুতীব্র হচ্ছে। আন্তঃ সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে এতদ্বাঞ্চলকে নিয়ে মার্কিনের ইন্দো-প্যাসিফিক করিডোর, জাপানে বে অব বেঙ্গল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল গ্রথ বেল্ট (বিগ-বি), টিকফা, সোফা, টিপিপি(TPP), টিটিআইপি(TTIP) ইত্যাদি চুক্তি করে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া এসসিও (SCO), রিক(RIC), ব্রিকস(BRICS) ও বিসিম(BCIM) করিডোর ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলায় বিশ্বযুদ্ধে আশঙ্কা ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এপ্রেক্ষিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশকে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চায়। এ অবস্থায় বিগত ৫ জানুয়ায়ী’১৪ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিনের নেতৃত্বে পাশ্চাত্ব্যের সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু, পদ্মা সেতু ইস্যু, রহিঙ্গা ইস্যু, গার্মেন্টস সেক্টরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বাতিল ইত্যাদি কারণে মহাজোট সরকারের টানা পোড়ন বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও পুঁজিবাদী চীনের সাথে মহাজোট সরকারের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের দালাল বিএনপি’র নেতৃত্বে ২০দলীয় জোট জনজীবন ও জাতীয় জীবনের সমস্যাকে আড়াল করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আর্শীবাদ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে নানামুখি তৎপরতা চালাতে চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ একটি নয়াউপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ। অতীত থেকে অনেক জাতীয় স্বার্থ বিরোধী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে যা জাতীয় স্বার্থ বা জনগণের স্বার্থের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। কারণ আমাদের দেশের সরকারগুলো সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে চলে। আজ তাই মহাজোট সরকারের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ জাতীয় ও জনস্বার্থ বিরোধী সকল পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের সকল অপতৎপরতা রুখে দাঁড়াতে হবে। সংঘটিত করতে হবে সকল সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এ জন্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি বিরোধী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। তাই আসুন মুক্তির লক্ষ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপ দিয়ে গন্তব্যে অগ্রসর হই। প্রতিষ্ঠা করি শ্রমিক করি শ্রমিক কৃষক জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান। তাই আসুন
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সংশ্লিষ্ট জনবসতি উচ্ছেদ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোল।
আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুন।
সংগ্রামী সাথী ও বন্ধুগণ
অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আপনারা জানেন সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার পরিকল্পনায় পাবনা জেলার ঈশ্বরদী রূপপুরে ১ হাজার মেগাওয়াট শক্তি সম্পন্ন দুইটি বিপদজনক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। পারমাণবিক বিদ্যুতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও ক্ষতিকারক দিক থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণ তথা দেশবাসীকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এব্ং আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার বেঁধে দেওয়া ৬৩ প্রকার প্রাক সমীক্ষার রির্পোট প্রকাশ ছাড়াই শুরু করতে যাচ্ছে প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ।
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার দলিলে নির্ধারণ করে দিয়েছে ২৫০ এবং ৫০০ মেগাওয়াট শক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ২.৪ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এলাকা এবং পরে ৫ কিলোমিটার এলাকা ব্যাসার্ধ জুড়ে জন মানব শূণ্য করতে হবে। তারপর ১৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১০ হাজারের বেশি জনসংখ্যার বসতি থাকা চলবে না। আরো ৫ কিলোমিটার পরে ৫০ হাজারের বেশি বা ১ লাখের ওপরে জনবসতি থাকবে না। নতুন ইউনিট হলে এই এলাকার বসতি আরো দূরে সরিয়ে নিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানোর প্রয়োজন হবে। রূপপুরের ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক দলিল অনুযায়ী জমি অধিগ্রহণ করে মানুষের বাড়িঘর উচ্ছেদের কার্যক্রম শুরু হবে এটাই স্বাভাবিক। তাহলে সরকার জেনে শুনে পাবনা ঈশ্বরদী, নাটোর, ভেড়ামারা ও কুষ্টিয়ার বিশাল অঞ্চলের প্রায় ৩০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনকে ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। আর কেনই বা সরকার জনগণের বিপুল অংকের ট্যাক্সের লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে এই ধরণের মহাবিপদজনক দানবকে দেশের জনগণের ঘাড়ে চাঁপিয়ে দিচ্ছে। যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তেজস্ক্রীয়তায় এ অঞ্চলের ২৫-৩০ কিলোমিটার এলাকার পরিবেশকে ধ্বংস করবে, কৃষি আবাদ, আম, লিচু, কাঁঠাল, শাক-সবজি, ফসল উৎপাদনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে, মানুষের চাষের জমি কেড়ে নিবে, বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করবে, নদীর পানিকে করবে দূষিত, আর সেটা বিস্ফোরিত হলে ঈশ্বরদী, পাবনা, নাটোর, কুষ্টিয়া জেলার ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে মহাবিপদ ও ধ্বংসলীলা সুষ্টি করবে।
মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা পারমাণু থেকে যে শক্তি পাওয়া যায় সেটাই পারমাণবিক শক্তি। এ শক্তি যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে বোমা বানিয়ে সভ্যতা ধ্বংষ করা এবং শান্তিপূর্ণ কাজ দু’ভাবেই ব্যবহার করা যায়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার স্বীকৃত হলেও তাতে থাকে সমস্যা ও বিপদের আশংকা। মূলত ফিউশন প্রক্রিয়ায় পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন হয়। প্লুটোনিয়াম, থোরিয়াম ও নিউট্রন এর সাথে সংঘর্ষ করেই ফিউশন প্রক্রিয়া চালাতে হয়। এতে ৯০ ভাগ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয়। ইউরেনিয়াম প্রচুর পানি দিয়ে শোধন করতে হয়। ৬০এর দশকের শুরুতে প্রমত্ত পদ্মার অবাধ প্রবাহকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে রূপপুরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের ৪০ কিলোমিটার উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার ফলে সেই পদ্মা এখন মৃত নদী। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ না থাকলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পদ্ধতি চালু হবে না। সরকার বলছে সরকার বলছে পদ্মা শুকিয়ে গেলে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হবে, কিন্তু এতো বিপুল পরিমাণ পানি ভূ-গর্ভ থেকে উত্তোলন করা হলে পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে। মানুষের খাবার পানিসহ চাষাবাদের সেচের পানির মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হবে, ধ্বংস হবে সামগ্রিক কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা। ভয়াবহভাবে আর্সেনিক দূষণ আরো বৃদ্ধি পাবে। এমনিতেই ভূমিকম্পের মত প্রাকৃতিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এ অঞ্চল। বিষাক্ত তেজস্ক্রীয়তা বাতাসে রেডিয়েশন হয়ে দূরাঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে এবং প্রাণী দেহে স্থায়ী ক্ষতি করবে। শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ, ক্যান্সার ও জননতন্ত্রের বিরূপ প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়ে প্রাণীকূলের অকাল মৃত্যু ডেকে আনবে।
বন্ধুগণ
বর্তমানে সারা দুনিয়াতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ৪৪০টির মত। এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দূর্ঘটনা ও বিপর্যয় ঘটেছে শতাধিকের মত। এ সব দূর্ঘটনা ও বিপর্যয়ের কারণে মানুষের প্রাণহানী, জীববৈচিত্র ধ্বংসসহ সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কয়েক শত বছরেও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। রূপপুরে রাশিয়ার তৈরি ভিভিইআর ১০০০ মডেলের অত্যাধুনিক থ্রী প্রযুক্তির চুল্লি বসানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রযুক্তি ও নকশার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, রাশিয়ার এই প্রযুক্তি ও নকশা নাকি ১৯৭০ এর দশকের ডিজাইনের সংশোধিত রূপ নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। রাশিয়া দাবি করছে এ ধরণের চুল্লির দূর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনা নেই এবং ১০ মাত্রার ভূমিকম্প ও বিমানের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। রাশিয়ার চেরেনোবিল ধ্বংসলীলা ও ২০১১ সালের মার্চে জাপানের ফুকুশিমা পরমাণু বিপর্যয় ও ধ্বংসযজ্ঞের ইতিহাস বিশ্ববাসী জানে। কিন্তু তাদের এই প্রযুক্তির অনেক ধরণের ত্রুটি ও ঝুঁকি থাকার কারণে ইউরোপের অনেক দেশ এই ভিভিইআর ১০০০ প্রযুক্তির চুল্লি ক্রয়ের ১১টি চুক্তি বাতিল করে দিয়েছে। দেশগুলো হলো হাঙ্গেরীর ২টি, ইউক্রেন ৩টি, জার্মানীর ৪টি, চেক রিপাবলিক ২টি। ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যের কুডানকুলাম অঞ্চলে ঐ ভিভিইআর ১০০০ এর দুইটি চুল্লি ২০০৮ সালে বসানোর পর সেখানে জনগণের আন্দোলনের মুখে আজ পর্যন্ত চালু করতে পারেনি। এই চুল্লি বসালে এতদ্বাঞ্চলে আধুনিকীকরণ করা হবে, ১০ হাজার লোকের কর্ম সংস্থান হবে, জমি অধিগ্রহণ হবে না, বাড়িঘর উচ্ছেদ হবে না- এই ধরণের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত সরকার। কিন্তু জনগণ প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে যে কারণে আজ পর্যন্ত প্রকল্প চালু করতে পারেনি। এই তুরস্ক ও ভিয়েতনাম রাশিয়ার ঐ ভিভিইআর ১০০০ প্রযুক্তি নগদে ৩৩ হাজার কোটি টাকায় কিনে বিপদে পড়েছে। তারাও এই প্রযুক্তি রাশিয়ায় ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার ১.৫ বিলিয়ন ডলার (১৫ হাজার কোটি টাকা) এতো সস্তা দামে তাও আবার বাকীতে রূপপুরে নির্মাণ করে দিবে- এটা কোন ধরণের অত্যাধুনিক থ্রী জি প্রযুক্তি?
সংগ্রামী সাথীরা
পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ২০০৮ সাল থেকে মন্দায় নিমজ্জিত হয়ে ৮ বছর অতিক্রম করলেও তা থেকে পরিত্রাণ না পেয়ে মন্দা থেকে মহামন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে এর থেকে পরিত্রাণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পুঁজি ও শক্তির অনুপাতে বাজার ও প্রভাব বলয় বন্টন-পুনর্বন্টন ও সর্বোচ্চ মুনাফার লক্ষ্যে দেশে দেশে একচেটিয়া বা লগ্নিপুঁজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এ প্রেক্ষিতে চলছে বাণিজ্যযুদ্ধ, মুদ্রাযুদ্ধ, স্থানীয়যুদ্ধ এবং বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে সংঘটিত হচ্ছে শ্রম-পুঁজির দ্বন্দ্ব। দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান আঞ্চলিক শক্তি নয়াউপনিবেশিক ভারতকে কেন্দ্র করে এতদ্বাঞ্চলে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব সুতীব্র। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নয়াউপনিবেশিক দেশসমূহে সাম্রাজ্যবাদের সাথে নিপীড়িত জাতি ও জনগণের দ্বন্দ্ব সুতীব্র হচ্ছে। আন্তঃ সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে এতদ্বাঞ্চলকে নিয়ে মার্কিনের ইন্দো-প্যাসিফিক করিডোর, জাপানে বে অব বেঙ্গল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল গ্রথ বেল্ট (বিগ-বি), টিকফা, সোফা, টিপিপি(TPP), টিটিআইপি(TTIP) ইত্যাদি চুক্তি করে অগ্রসর হচ্ছে। অন্যদিকে চীন-রাশিয়া এসসিও (SCO), রিক(RIC), ব্রিকস(BRICS) ও বিসিম(BCIM) করিডোর ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলায় বিশ্বযুদ্ধে আশঙ্কা ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এপ্রেক্ষিতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশকে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চায়। এ অবস্থায় বিগত ৫ জানুয়ায়ী’১৪ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিনের নেতৃত্বে পাশ্চাত্ব্যের সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু, পদ্মা সেতু ইস্যু, রহিঙ্গা ইস্যু, গার্মেন্টস সেক্টরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা বাতিল ইত্যাদি কারণে মহাজোট সরকারের টানা পোড়ন বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও পুঁজিবাদী চীনের সাথে মহাজোট সরকারের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। সাম্রাজ্যবাদের দালাল বিএনপি’র নেতৃত্বে ২০দলীয় জোট জনজীবন ও জাতীয় জীবনের সমস্যাকে আড়াল করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আর্শীবাদ নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে নানামুখি তৎপরতা চালাতে চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ একটি নয়াউপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ। অতীত থেকে অনেক জাতীয় স্বার্থ বিরোধী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে যা জাতীয় স্বার্থ বা জনগণের স্বার্থের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। কারণ আমাদের দেশের সরকারগুলো সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে চলে। আজ তাই মহাজোট সরকারের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণসহ জাতীয় ও জনস্বার্থ বিরোধী সকল পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের সকল অপতৎপরতা রুখে দাঁড়াতে হবে। সংঘটিত করতে হবে সকল সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এ জন্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি বিরোধী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা। তাই আসুন মুক্তির লক্ষ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে রূপ দিয়ে গন্তব্যে অগ্রসর হই। প্রতিষ্ঠা করি শ্রমিক করি শ্রমিক কৃষক জনগণের রাষ্ট্র, সরকার ও সংবিধান। তাই আসুন