জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের ঘোষণাপত্র
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী লড়াইয়ের মাধ্যমে জন্মলাভ করেনি বিধায় এদেশের সমাজদেহে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা দালাল পুঁজির শোষণ অব্যাহত রয়ে গেছে। এই শোষণমূলক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সঙ্কটকে গভীর থেকে গভীরতর করছে এবং জনজীবনকে বিপর্যস্ত ও সঙ্কটাপন্ন করে ঠেলে দিচ্ছে এক চরম অনিশ্চয়তার দিকে। সমাজের সকল শ্রেণির মেহনতি জনগণ এ পরিস্থিতির শিকার। দেশের সংখ্যারিষ্ঠ অংশ কৃষক জোতদারি-মহাজনী তথা সামন্ততান্ত্রিক শোষণে পিষ্ট। কৃষি উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়ে, ভূমি সম্পর্কের বিভিন্ন জটিল রূপের ফলশ্র“তিতে মাঝারি কৃষক জমি হারিয়ে গরিব-ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হচ্ছে। গ্রামীন জনসংখ্যার ৭২% জন ভূমিহীন ও গরিব কৃষক। শহরে অবস্থানরত বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত, অফিস আদালতে চাকুরিরত, সাধারণ ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনও দুর্বিষহ। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, আয়-ব্যয়ের বৈষম্য এবং প্রতিনিয়ত জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়ায় এই অংশসমূহকে দিশেহারা করছে। দেশের শিক্ষিত জনতাসহ ছাত্র সমাজের দশাও একই রকম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট আমলা ও কেরানী সৃষ্টির শিক্ষা ব্যবস্থা অব্যাহত থাকায় একদিকে যেমন ব্যাপক জনগণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, অন্যদিকে তেমনি ডিগ্রিধারি বেকারের পরিমাণ মাত্রারিতিক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ডিপ্লোমাধারি, টেকনিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিতরাও আজ বেকার। দেশের শিল্প কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকসহ মুটে-মজুর, রিক্সাওয়ালা ইত্যাদি শ্রমজীবী জনগণের জীবন আজ গভীরভাবে সঙ্কটাপন্ন। এক কথায় বিভিন্ন শ্রেণির জনগণ জীবন-জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে দুরবস্থা তীব্রতর। কৃষি, শিল্প, শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে সীমাহীন অরাজকতা। জনগণের সম্পত্তি ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিল্প বিকাশে কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি জাতীয় শিল্প প্রয়াসকে কণ্ঠরুদ্ধ করে রেখেছে। শিল্পক্ষেত্রসহ গোটা জাতীয় অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রগুলি নিয়ন্ত্রণ করছে সাম্রাজ্যবাদ এবং চলছে সাম্রাজ্যবাদী নয়াঔপনিবেশিক নির্মম শোষণ ও লুণ্ঠন। জনগণের ঘাড়ে চেপে বসেছে প্রায় ৩,৮০০ কোটি ডলার বিদেশী ঋণ ও অনুদানের বোঝা। অবাধ আমদানী নীতি ও অসম বাণিজ্যের মাধ্যমে লুট করে নেওয়া হচ্ছে আমাদের দেশের সম্পদ। বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৩২ হাজার কোটি টাকা। ঋণ ও বাণিজ্যিক ঘাটতি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে ফলে প্রতিপদে শিল্প বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এবং যেসব সামান্য শিল্প গড়ে উঠেছে তারও অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। এরই ফলশ্র“তিতে শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। জাতীয় অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছ। বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালাল জোতদার, মহাজন-আমলা দালাল পুঁজির নিরন্তর শোষণে কৃষক জনগণ জর্জরিত। প্রতিটি শিক্ষাঙ্গন মাস্তানদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রেও বিরাজ করছে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। হত্যা, গুম, খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, নারীহত্যা, নারীধর্ষণ, প্রাত্যাহিক ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি এক সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গা, প্রো, রিয়াং, খুমি, চাক, মুরং, বনযোগী, পাংকো, লুসাই, সিলেট-ময়মনসিংহ অঞ্চলে মনিপুরী, খাসিয়া, গারো, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন ঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা সাঁওতাল ইত্যাদি ক্ষুদ্র জাতিত্ত্বার সকল অধিকার উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের পদতলে পিষ্ট হচ্ছে। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহের বিকাশ আজ রুদ্ধ যার ফলশ্রুতিতে বৃহৎ বাঙালী জাতির সাথে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাসমূহে দ্বন্দ্ব জাতিগত সঙ্কটকে তীব্র করছে।
দেশের এই চরম অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কট এবং জাতিগত বৈষম্যের কারণ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা দালাল পুঁজির শোষণ। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগমনের মধ্য দিয়ে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আঁতাতে উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশকে প্রতিহত করে যে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা কায়েম হয় সেই ব্যবস্থা মূলতঃ আজও অব্যাহত রয়েছে। যুগ যুগ ধরে এদেশের জনগণ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করে আসছেন কিন্তু সংগ্রামের পরিণত আজও হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের সুতীব্র হলে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিক শোষণকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে গ্রহণ করে নয়াঔপনিবেশিক কৗশল। এই পদ্ধতিতেই সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট দালাল শ্রেণীর মাধ্যমে নয়াঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। ভারতবর্ষের জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আকাঙ্খাকে সাম্রাজ্যবাদের দালালরা ব্যবহার করে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় নয়াঔপনিবেশিক ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। পাকিস্তান ও ভারত নামক যে রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়, তার চরিত্র হয় নয়াঔপনিবেশিক তাই পাকিস্তান আমলেও এই সমস্যা অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশও সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিননিতে সৃষ্টি হয়নি। ফলে অর্জিত হয় না প্রকৃত স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতিসত্ত্বাসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার। বাংলাদেশ বর্তমানে একটি নয়া–ঔপনিবেশিক, আধা–সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র।
বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দী পুঁজি বিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি রয়ে গেছে অসমাপ্ত। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ তার মদদপুষ্ট নয়াঔপনিবেশিক ভারতের শাসক-শোষকগোষ্ঠিকে দিয়ে বাঙালী জাতিসত্ত্বার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আকাঙ্খাকে কাজে লাগিয়ে উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সৃষ্টি করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। বাংলাদেশে কার্যকরি হয় সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য ও প্রভাব বলয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে রুশ-ভারতের প্রাধান্যের বদলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতাসীন হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল খন্দকার মোস্তাক আহমেদ সরকারের ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমান সরকার। সামনে আনা হয় ও পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয় সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও রাজনীতি। ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারি এরশাদ সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান আরো সুসংহত করা হয়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা অপর পরাশক্তি সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তার প্রভাববলয়কে বিপর্যস্ত করে “এক বিশ্ব ব্যবস্থা” (Uni-Polar World System) প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা কার্যকরি করার লক্ষ্যে বিশ্ব্যাপি তাদের কার্যক্রম অগ্রসর করে চলে ও সফল হয়। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর শহর কেন্দ্রীক ছাত্র যুব-মধ্যবিত্তদের আন্দোলন সংগ্রাম-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারি এরশাদ সরকারের পরিবর্তন ঘটানো হয়। নয়াঔপনিবেশিক শোষণ তীব্রতর করা, শ্রমিক-কৃষক-জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করা এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল দলগুলোর দ্দন্দ্ব নিয়ন্ত্রিত করার জন্য সামনে আনা হয় ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার মডেল’। এ প্রক্ষিতে ১৯৯১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে সাম্রাজ্যবাদের আরেক দালাল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার। এ সময়কালে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে ১৯৯১ সালে আলবেনিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতন এবং পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের পতন। ফলে একক পরাশক্তি হিসেবে সামনে আসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির শোষণ-লুণ্ঠন তীব্রতর করার লক্ষ্যে জোরেসোরে সামনে আনা হয় মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং বিশ্বায়নের শ্লোগান ও কার্যক্রম। এ প্রেক্ষিতে আমাদের মত নয়াঔপনিবেশিক দেশগুলোতে বিশ্বব্যাংক (World Bank), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (IMF), বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO), এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB), প্যারিস সাহায্য সংস্থা ইত্যাদি বিশ্ব সংস্থার নীতি-নির্দেশে শিল্পক্ষেত্রে ঢালাও বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যক্তিমালিকানার নীতি; কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও ব্যক্তি মালিকানায় কৃষি উপকরণ বিপণন নীতি; অবাধ আমদানী নীতি; অবাধ মুদ্রা নীতি ইত্যাদি কার্যক্রম জোরদার করে। তাছাড়া সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (FDI) , যৌথ বিনিয়োগ (Joint venture), রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (EPZ), শেয়ার বাজার ইত্যাদি ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করা হয়।
বাজার ও প্রভাব বলয় নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী শফক্ত সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া চলে। এ প্রেক্ষিতে সামনে আসে মার্কিন নেতৃত্বে নাফটা (NAFTA), ফাটা (FATA), প্রক্রিয়া। ফ্রান্স, জার্মানকে সামনে রেখে অখন্ড ইউরোপ প্রক্রিয়া; এপেক (APEC)) প্রক্রিয়া যার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থাকলেও জাপান সামনে আসার দি থাকে। যা সাম্প্রতিক সময়ে জাপানকে সামনে রেখে পুঁজিবাদী চীনকে অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ব এশিয়ার ১৩টি দেশকে নিয়ে পূর্ব এশিয়া জোট হিসেবে সামনে আসছে। তাছাড়া একক পরাশক্তি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে একবিশ্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ও পুঁজিবাদী চীন বহুকেন্দ্রীয় বিশ্ব ব্যবস্থার শ্লোগান তুলে ধরে।
উপমহাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র এর প্রভাব পড়ে। নয়াঔপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী ভারতে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের প্রাধান্যের বদলে প্রতিষ্ঠিত হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রাধান্য। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে রুশ-ভারতপন্থী দল আওয়ামী লীগ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পুরোপুরি দালালে পরিণত হয়। ভারতের বিশাল বাজার, সস্তা শ্রম, বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে প্রধান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের রণনীতিগত গুরুত্ব বেশি হওয়ার কারণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো ভারতকে কেন্দ্র করে এতদ্বাঞ্চলে তাদের সামগ্রিক বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস ঘটাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে নয়াঔপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠন তীব্রতর করা, শ্রমিক-কৃষক-জনগণকে আন্দোলন-সংগ্রাম বিপ্লবের পথ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে বিভ্রান্ত, বিভক্ত ও বিপথগামী করার লক্ষ্যে এবং তাদের দালাল দলগুলোর দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের সাধারণ কর্মনীতির আলোকে এদেশে অগ্রসর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মডেল। উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে সাম্রাজ্যবাদের দালাল খাদেলা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের পরিবর্তে আরেক দালাল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। সাম্রাজ্যবাদের দালাল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সরকার সাম্রাজ্যবাদের তুলে ধরা মুক্ত বাজার অর্থনীতি ও বিশ্বায়ন কার্যকরীকরণ জোরদার করায় শিল্প, কৃষিসহ গোটা জাতীয় অর্থনীতিতে সঙ্কট আরো ঘনীভূত করে। বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ- গ্যাস, সম্ভাব্য তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদ অবাধে লুটপাট চালানোর জন্য সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানীর হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার সাথে সম্পৃক্ত ভারতের শাসক শোষকগোষ্ঠির স্বার্থে আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক জাতীয স্বার্থ বিরোধী চুক্তি সম্পাদন ও কার্যকরী করে চলে।
তিন শত্রুর শোষণ-লুণ্ঠনকে তীব্রতর করা এবং শ্রমিক-কৃষক-জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম দমন করার লক্ষ্যে একের পর এক কালা-কানুন জারি করে সরকারের স্বৈরশাসন তীব্র থেকে তীব্রতর করে। বভাংলাদেশে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা বহির্ভূত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলাম ঐক্যজোট ইত্যাদি সকল দলই সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তাই শোষকগোষ্ঠির ক্ষমতার পালাবদলে সাম্রাজ্যবাদের দালাল দলগুলো যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা তিন শত্রুর স্বার্থের সেবা করবে, এতে শ্রমিক-কৃষক-জনগণের লাভ নেই।
ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সহ বাম নামধারী সংশোধনবাদী দলগুলো মুখে কিছু বামপন্থী কথাবার্তা বললেও “৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির ঐক্য” ও “মৌলবাদ বিরোধিতা” নামে ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে। বাম নামধারী এই সব সংশোধনবাদী দল পুঁজিবাদী চীনকে সমাজতান্ত্রিক আখ্যায়িত করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে সংশোধনবাদী নতুন ধারা কার্যকরি রয়েছে তারা “বিকল্প ধারা” হিসেবে আখ্যায়িত করে কর্মি ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়।
এ পরিস্থিতিতে জাতীয় জীবনের প্রয়োজন মিটিয়ে জনগণের আকাঙ্খাকে মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিতে পারে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক শক্তি। প্রচলিত আর্থ-সামাজিক কাঠামো অটুট রেখে স্বৈরতন্ত্রের অধীনে প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তাই এই আর্থ-সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের জন্য জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার লক্ষ্যে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলা ও অগ্রসর করার পরিপ্রেক্ষিত নির্বাচনের বিষয়টা বিবেচনা করা যেতে পারে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। আজ তাই গণতান্ত্রিক শক্তিকে বিকল্প শক্তি হিসেবে সামনে আসতে হবে। এ জন্য সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজি বিরোধী সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চলমান আন্দোলনকে সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত করতে হবে। এই ঐক্য বিভিন্ন শ্রেণীর ঐক্য। এই ঐক্য জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লরে ঐক্য। এটা নিছক রাজনৈতিক দলসমূহের তথাকথিত ঐক্য নয়। এদেশের দালাল রাজনৈতিক দলসমূহ সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিভিন্ন শ্রেণীকে বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করে তাদের স্বার্থ হাসিল রছে। দালাল রাজনৈতিক দলগুলি ঐক্যবদ্ধ হলেই তাদের অঙ্গ সংগঠনসমূহও ঐক্যবদ্ধ হয় ্এবং দালাল বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্রন্ট গঠনের এই নয়া ঔপনিবেশিক কৌশলের বিপরীতে শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি জনগণ, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রসহ সকল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানানো হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দুই বিশ্বস্ত দালাল সামন্ত ও আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজির একনায়কত্ব। এদেশের জনগণের ওপর চেপে বসে আছে তিন শক্তি- সাম্রাজ্যবাদ ও তার দুই দালাল সামন্তবাদী জোতদার-মহাজন ও আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজি। এই তিন শোষণের যাতাকলের নীচে পিষ্ট হচ্ছে জাতীয় জীবনের সমস্ত আশা আকাঙ্খা। যে রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা এই তিন শোষণের ধারকবাহক। এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটিয়ে শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় বুর্জোয়াদের স্বার্থের পতাকাবাহী সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও আমলা মুৎসুদিদ্দ পুঁজি বিরোধী শ্রমিক-কৃষক, জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। তাহলেই জাতীয় জবিনে সৃষ্টি হবে গতি এবং দেখা দেবে সৃজনশীল শ্রমের এক মহান বিকাশ। জনজীবনের শোষণ পীড়ন ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির আর কোন বিকল্প পথ নেই। তাই আসুন এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে নিম্নলিখিত কর্মসূচিকে সামনে রেখে সারা দেশব্যাপি গড়ে তুলি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট।